বিদায় খালেদা জিয়া: সব চেষ্টা ব্যর্থ, চলে গেলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১:৫৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আজ মঙ্গলবার সকাল সোয়া সাতটার দিকে জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁকে জানিয়েছেন, “আম্মা আর নেই।”
এর আগে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন জানান, খালেদা জিয়া সকাল সাড়ে ছয়টার সময় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁর পাশে তারেক রহমান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা ছিলেন।
খালেদা জিয়ার জানাজা আগামীকাল বুধবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পেয়েছিলেন। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে জীবনের পরম সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন থাকে। মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ—এসবও তাঁদের জীবনে অভাবনীয় নয়। খালেদা জিয়াও চরম পর্যায়ের এমন নির্যাতন সহ্য করেছেন। সহ্য করেছেন স্বামী–সন্তান হারানোর গভীর শোকসন্তাপ আর দীর্ঘ রোগযন্ত্রণা।
রাজনৈতিক জীবনে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াও প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে (তবে এই তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মতপার্থক্য রয়েছে)। তাঁর বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরামের শ্রীপুর গ্রামে। মা তৈয়বা বেগমের জন্ম পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ীতে। তাঁদের তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে খালেদা জিয়া তৃতীয়। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ‘খালেদা খানম’। অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন বলে বাড়ির লোকেরা তাঁকে ‘পুতুল’ বলে ডাকতেন। সেটিই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়।
প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন সেন্ট যোসেফ কনভেন্টে। পরে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চমাধ্যমিক) উত্তীর্ণ হন।
ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ধার্মিক ও উদার মানসিকতাসম্পন্ন। তাঁর বাড়িতে সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশও ছিল। বড় মেয়ে খুরশিদ জাহান হক গান এবং খালেদা খানম নৃত্যের চর্চা করতেন। বাড়িতে আরবি শিক্ষকের পাশাপাশি সংগীত ও নৃত্যের শিক্ষকও ছিলেন। শৈশবে দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে তিনি সমাদৃত হয়েছেন।
মা তৈয়বা বেগমের রান্নার হাত ছিল চমৎকার। মেয়েদের তিনি রান্না শিখিয়েছেন। মায়ের কাছ থেকেই খালেদা খানম তিন বোনের মধ্যে রান্নার গুণ সবচেয়ে ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন।
খালেদা খানমের বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে বলা হয়েছে, শৈশব থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি ছিল তাঁর নিবিড় অনুরাগ। নিজের ঘর পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতেন। পরবর্তী জীবনেও এই অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন।
সেনাবাহিনীর তরুণ ও চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের মুদিপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে খালেদা খানমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের প্রসঙ্গে এক জীবনীকার লিখেছেন (প্রাগুক্ত), ঘটক জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন,
“আপনি যদি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন, তাহলে আপনার বাড়িতে বিজলিবাতির দরকার হবে না। পাত্রী এত রূপসী যে তাঁর রূপের ছটায় সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।”
জিয়া হাসলেন এবং বিয়ে করতে সম্মত হলেন।
বিয়ের পর থেকেই তিনি ‘বেগম খালেদা জিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
জিয়া-খালেদা দম্পতির দুই ছেলে। জ্যেষ্ঠ তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। কনিষ্ঠ আরাফাত রহমান কোকোর জন্ম ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট। কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে শহীদ হন। মাত্র ২১ বছরের দাম্পত্য জীবন শেষে ৩৬ বছর বয়সে খালেদা জিয়া অকালবৈধব্য বরণ করেন।
পরিমিত আহার করতেন বেগম খালেদা জিয়া। ফল খেতে পছন্দ করতেন, বিশেষ করে নিয়মিত পেঁপের রস পান করতেন। প্রিয় খাবার ছিল সাদা ভাত, সবজি, মসুর ডাল ও মাছ। মাংস খেতেন, তবে তেমন পছন্দের ছিল না। শ্রোতা হিসেবে তিনি ভালো ছিলেন—অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। জীবনীকারেরা লিখেছেন, “প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ধীরে ধীরে বিচক্ষণ হয়ে ওঠেন” (বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম, মাহফুজ উল্লাহ)।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়েই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুরু। তাঁর মৃত্যুর পর বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক পথচলা।
খালেদা জিয়া রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই দলীয় শৃঙ্খলা ও নেতৃত্ব সুসংহত রাখার পাশাপাশি এইচ এম এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ভাইস চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়ে ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁর ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছর তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ছিলেন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে গঠিত হয় ৭-দলীয় ঐক্যজোট। ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৮৭ সালে শুরু করেন ‘এরশাদ হটাও’ একদফা আন্দোলন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়।
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে শপথ নেন খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আরও দুই দফা প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেন এবং কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মাত্র ১৪ দিনে তিনি প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন।
তবে তাঁর শাসনামলে দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। বিশেষ করে ২০০১–২০০৫ মেয়াদে বাংলাদেশ টানা পাঁচ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
খালেদা জিয়া জীবনের বড় একটি সময় বন্দিত্বের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সেনানিবাসে, ১৯৮১ সালে গৃহবন্দী, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সময়ে দীর্ঘ বন্দিত্ব এবং ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামমুখর।
মানবিক কারণে ২০২০ সালে তাঁকে শর্তসাপেক্ষে গৃহবন্দী অবস্থায় মুক্তি দেওয়া হয়। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাঁর দণ্ড মওকুফ হয়।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি লন্ডনে তাঁর চিকিৎসা হয়। কিছুটা সুস্থ হলেও বয়স ও নানা রোগের জটিলতায় তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে সর্বশেষ এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক মাসের বেশি সময় চিকিৎসাধীন থাকার পর অবশেষে তিনি আর সাড়া দিলেন না।
‘দেশনেত্রী’ খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।
১৪৪ বার পড়া হয়েছে