শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতার প্রয়োজনীয়তা
শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৮:২৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
শিক্ষার উদ্দেশ্য মানব সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষে রূপান্তর করা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার জন্য এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও সামাজিক চরিত্র অর্জন করে থাকে।
সর্বোপরি সে নিজেকে দুনিয়াতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার যোগ্য ব্যক্তিত্ব ও স্রষ্টার অনুগত এক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি কেবল পরীক্ষার নাম্বার, সার্টিফিকেট, চাকুরির দক্ষতা বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের মধ্যে সীমিত হয়ে যায়, তবে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তার মাধ্যমে অর্থসম্পদ অর্জন, ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচুর্য অর্জন ও খ্যাতি অর্জনসহ জাগতিক অনেক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ উত্তম মানুষ হওয়া সম্ভব হয় না। ফলশ্রুতিতে শিক্ষিত সমাজেও দেখা যায় হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা, অমানবিকতা, লোভ-লালসা ও চাটুকারিতা সয়লাব। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, এসবের মূলে রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি।
মানবিক মূল্যবোধ বা মানবিকতা হলো মানবসত্তায় লুকায়িত সেই উত্তম গুণ, যার মাধ্যমে মানুষ অন্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে, সহানুভূতি দেখায় ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এ গুণ ভালোবাসা, দয়া, সহমর্মিতা, ন্যায়বোধ ও নৈতিকতার সমন্বয়ে গঠিত এক মহৎ আদর্শ। মানবিক মানুষ পরার্থপরায়ণ হয়। ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাই তার নিকট হয় সম্মানিত ও নিরাপদ। সে হয় আল্লাহর বাণী—
“(হে মুসলিমগণ!) তোমরা সেই শ্রেষ্ঠতম দল, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের অস্তিত্ব দান করা হয়েছে।” (আলে ইমরান: ১১০)
—এর প্রতিচ্ছবি।
যার দৃষ্টান্ত দেখা যায় মহামানব, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে—এমনকি তাঁর নবুয়্যাত প্রাপ্তির পূর্বেই। যা প্রকাশিত হয়েছিল হযরত খাদিজাতুল কুবরার কণ্ঠে, মহানবী (সা.)-এর নিকট ওহী অবতরণের সূচনালগ্নেই। রাসূল (সা.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বলেন,
“আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি—আল্লাহ কখনো আপনার সম্মানহানি করবেন না। কেননা আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করেন, দুঃস্থ মানুষের দায়িত্বভার কাঁধে নেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং সত্যের পথে দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।” (বুখারী: ৩)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে বলেন,
“(হে নবী!) আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি।” (আল আম্বিয়া: ১০৭)
এই মানবিকতার কথাই ধ্বনিত হয়েছিল কবি কামিনী রায়ের কণ্ঠে—
“আপনাকে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকেই মোরা পরের তরে।”
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি ও ভোগবাদ যত বাড়ছে, মানবিকতার চর্চা ততই কমছে। কিন্তু বিশ্বসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে এর চর্চা অত্যন্ত জরুরি। এ মহৎ গুণটি এমনিতেই বিকশিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন চেষ্টা-সাধনা ও শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু নানাবিধ জ্ঞানদান ও অনুশীলনের মূল চালিকাশক্তি বা ব্যবস্থাপনা, তাই এ ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য শিক্ষার সাথে মানবিক বা নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ তা নেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়।
আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় দুইশত বছর পূর্বে ইংরেজদের দেওয়া কেরানি বানানোর ভোগবাদী, সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকার। যার অন্যতম স্লোগান হলো—
“লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।”
নিতান্ত বৈষয়িক ও উপস্থিত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ এবং নীতিহীন ভোগবাদ ও স্বার্থবাদই যার বৈশিষ্ট্য। এই ভোগবাদে উজ্জীবিত হয়েই মানুষ নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা সবই বিসর্জন দিয়ে বসে। ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থে মানবতাবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলেও তাদের স্থলাভিষিক্ত এ দেশীয় শাসকরা নিজেদের ও এ দেশবাসীর ভালো-মন্দ বিচার না করে শুধু বিদেশি প্রভুদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলছে।
তবে এ শিক্ষা ব্যবস্থার সবই খারাপ, সবই পরিত্যাজ্য—এমন কথা বলার অবকাশ নেই। কেননা এতে ব্যক্তি ও সমষ্টির জাগতিক জীবনের বৈষয়িক নানা বিষয়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতির বহু উপকরণ ও ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু প্রত্যেক বিষয় ও বস্তুর একটি কেন্দ্রীয় বা মূল অংশ থাকে, যা ঐ বিষয় বা বস্তুর মূল্যমান নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। ঐ মূল অংশের অনুপস্থিতিতে বস্তু বা বিষয়টি মূল্যহীন বা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া একেবারেই স্বাভাবিক।
অনুরূপ শিক্ষা ব্যবস্থারও একটি মূল অংশ আছে। যা না থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক মূল্যবান অংশসমূহ নিয়েও মূল্যহীন ও কুশিক্ষায় পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ব্যবস্থার সেই মূল অংশটির নাম ঈমান-আকিদা, আল্লাহ-রাসূল ও কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষা। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় এ মূল অংশটিই গুরুত্বহীন—ক্ষেত্রবিশেষে পরিত্যাজ্য হয়ে আছে। যার প্রেক্ষিতে শিক্ষা ব্যবস্থাটিই হয়ে পড়েছে এ জাতির জন্য প্রাণহীন কুশিক্ষার বাহন।
এর জ্বলন্ত প্রমাণ ইতোমধ্যে জনসম্মুখে দেদীপ্যমান। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষার অবর্তমানে সেই শূন্যস্থান দখল করে নেয় ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ, যা শিক্ষার্থীকে বানায় আল্লাহ অবিশ্বাসী। মার্কসীয় দর্শন, যা শিক্ষার্থীদের নবুয়্যাত, আখিরাত ও কিতাবের প্রতি চরম বিদ্রোহী করে তোলে। মেকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শন, যা তাদেরকে বানায় সুবিধাবাদী, প্রতারক ও ধোঁকাবাজ। এবং ফ্রয়েডের নীতিদর্শন, যা তাদেরকে উপহার দেয় যৌনতা ও ব্যভিচার। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি, যা তাদেরকে পৌত্তলিকতায় আগ্রহী করে তোলে।
এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উপরিউক্ত চিন্তা-বিশ্বাস ও ভাবধারাসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও ভূগোলশাস্ত্র স্থান পাওয়ায় এ দেশের অনেক মুসলিম পরিবারের ঈমানদার সন্তানরা ঐ সব শাস্ত্র গলাধঃকরণ করে সম্পূর্ণরূপে বিগড়ে যায়। আল্লাহ, রাসূল, কিতাব ও পরকালের প্রতি তারা ঈমান হারিয়ে ফেলে। ইসলামের হালাল-হারামকে তারা প্রথমে অস্বীকার করে, পরে তা হয় উপহাসের বস্তু। জড়িয়ে পড়ে তারা নানাবিধ অমানবিক কার্যক্রমে।
মুসলিম সন্তান আত্মপরিচয় হারিয়ে হয়ে পড়ে ব্লগার। আত্মপরিচয়হারা কোনো কোনো বড় রাজনৈতিক নেতাকেও বলতে শোনা যায়—
“আমি মুসলিমও না, হিন্দুও না, আমার কোনো ধর্ম নেই।”
একটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এর চেয়ে করুণ পরিণতি আর কী হতে পারে—যে তার শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয় পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে না!
শিক্ষার সর্বজনীন উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সর্বাঙ্গীন বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে পরিচালিত করা। আর শ্রেষ্ঠত্বলাভের অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো নৈতিকতাভিত্তিক মানবিকতা। শিক্ষাঙ্গণে এসে শিশুর বা শিক্ষার্থীর প্রধান শিক্ষা হবে নৈতিকতার শিক্ষা। নৈতিকতাভিত্তিক শিক্ষাই হলো ইসলামী শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেখানেই রয়েছে মানবিকতার মূলমন্ত্র।
পবিত্র কুরআন মাজীদে হযরত লোকমান (আ.) কর্তৃক তাঁর সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা মানবশিশু ও সন্তানদের কোন বিষয় শিক্ষা দেওয়া উচিত তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে দেখা যায় নৈতিক ও মানবিক শিক্ষাই প্রধান বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।
তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন—
“কোনো পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম কিছু দিতে পারে না।” (তিরমিযী, হাদীস নং: ১৯৫২)
মুসলিম শরীফের এক হাদীসেও সৎচরিত্রবান সন্তান রেখে যাওয়া এবং সন্তানকে সৎ ও ইসলামী চরিত্র ও মানবিক শিক্ষা দেওয়া পিতা-মাতার কর্তব্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবজীবন ও সমাজকে সমস্যামুক্ত, সুখময় ও শান্তিময় করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের সাথে নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষাকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। শিক্ষার সকল স্তরেই এ শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নচেৎ শিক্ষা যথার্থ অর্থে শিক্ষার্থীর মানসপটে প্রতিফলিত হবে না।
নৈতিক শিক্ষা বা মানবিক শিক্ষা সকল মানুষের জন্য ফরজে আইন—ব্যক্তিগতভাবে আবশ্যক। শিক্ষার্থীর সমগ্র শিক্ষাজীবনব্যাপী এ শিক্ষা না দিলে সে পূর্ণ মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। ফলে বড় শিক্ষিত হয়েও সমাজে থেকে যেতে হবে নৈতিকতাবর্জিত, পশুসম অমানবিক মানুষ হিসেবে—যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
*সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
১৪৬ বার পড়া হয়েছে