খাজা পরিবারের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত

সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫ ৯:৪০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলার ইতিহাসের এক মহিমাময় অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছে এক আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃষ্টিশীল পরিবার—খাজা নাছের আলী রহ: এর পরিবার, যারা মূলত কাশ্মির থেকে আগত হলেও, তাদের এক শাখা ইরাক থেকেও আগমন করে।
দুই উৎস থেকেই আগত এই পরিবারের সদস্যরা আত্মিক জ্ঞানের পাশাপাশি পার্থিব জীবনে বাণিজ্য, শিক্ষা ও কৃষিতে অভাবনীয় অবদান রেখেছেন। তাঁদের পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি, সুফীবাদে আস্থাশীলতা এবং ইসলামী অনুশাসনের প্রতি নিষ্ঠা তাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামষ্টিক সমাজজীবনকে ছুঁয়ে গেছে।
আদি ঐতিহ্য ও আগমন
কাশ্মির ও ইরাক—এই দুই ভৌগোলিক উৎস থেকেই আগত খাজা পরিবার বাংলার মাটিতে তাদের আত্মিক ও সামাজিক অবদান রাখে। মুসলিম বিশ্বে যখন সুফীবাদ ছিলো আত্মশুদ্ধির প্রধান পথ, তখন এই পরিবার সেই ধারাকে ধারণ করে বাংলায় প্রবেশ করে। শুধু ধর্ম নয়, তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি ও সমাজকল্যাণে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখনকার সময়ে ঢাকা নগর ছিল এক পুরাতন নগরী; খাজা পরিবারের সক্রিয় ভূমিকা এবং দিকনির্দেশনায় এই শহর নতুন প্রাণ ফিরে পায়। নবাবদের আগমন ও শাসন কাঠামোর উত্থানের পেছনেও এই পরিবারের অর্থনৈতিক ও জ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য।
তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়, জ্ঞান ও দানের মাধ্যমে ভারসাম্য তৈরি করা। খাজা পরিবার প্রমাণ করেছে যে, দানশীলতা কেবল অর্থ বিতরণ নয়, বরং জ্ঞান, পরামর্শ, উদারতা ও নেতৃত্বও একটি মহান দানের অংশ।
মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ থেকে মৌলভী খাজা নাছের আলী রহঃ
ঐতিহ্যবাহী খাজা পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ছিলেন এক গম্ভীর, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরী মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ) ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক ও সমাজসংস্কারক, যিনি সূফীবাদের নির্যাসকে বাস্তব জীবনে বাস্তবায়ন করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি শুধু নিজের আত্মশুদ্ধি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, বরং তার কর্মকাণ্ডে সমাজের গরিব, মেহনতি ও ধর্মপ্রাণ মানুষের উন্নতি ও আত্মিক শুদ্ধি লাভে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
তাঁর সাধনা ছিল নিরব, কিন্তু প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। দান, শিক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ইনসাফ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা ছিল তাঁর জীবনদর্শন। তাঁর কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হতো:
"জুলুমের সাথে নয়, মাজলুমের পাশে দাঁড়াও।"
উত্তরসূরী ও পূর্বসূরীর গৌরবগাথা
এই পরিবারের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে বলা চলে যে, পূর্বসূরী ছিলেন — আল্লামা শাহসুফী খাজা ছলেমউদ্দীন (রহঃ), যিনি পিতা হিসেবে একজন বুজুর্গ ও পূর্ণাঙ্গ আত্মিক গাইডের ভূমিকায় ছিলেন।
উত্তরসূরী হয়েছেন — মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ), যিনি তার পিতার রেখে যাওয়া আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করেছেন সততা, ত্যাগ ও আল্লাহপ্রেমের মাধ্যমে।
এ যেন এক ধারাবাহিকতার পথ যেখানে পরস্পরের দিকনির্দেশনা, দোয়া, আদর্শ ও কর্মফল বয়ে নিয়ে এসেছে পুরো সমাজকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক আবহে।
কালের চক্রে খাজা পরিবার
একশো বছরের বেশি সময় ধরে খাজা পরিবার সমাজে বিভিন্ন স্তরে কখনো শীর্ষে চূড়ায় অবস্থান করেছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ধনী ও ক্ষমতাধর অবস্থান থেকেও পরিবারটি কখনো জুলুম-অত্যাচারে লিপ্ত হয়নি। বরং তারা কখনো অর্থহীন হলেও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বিচ্যুত হননি।
এর পেছনে সময়ের সাথে তাল না মেলাতে পারা, রাজনীতির গতিপথ বুঝে না চলা কিংবা একরকম আধ্যাত্মিক নৈর্ব্যক্তিকতা দায়ী বলে অনুমান করা যায়। তাঁরা সময়োপযোগী জাগরণে সক্রিয় হননি, সম্ভবত আত্মমগ্নতাই তাঁদের সমাজিক ভূমিকা দুর্বল করে ফেলে। তবে এই পরিবার কখনো ক্ষমতার লোভে অপসৃয়মান হননি, বরং পছন্দ করেছেন নিঃশব্দ আত্মত্যাগ ও আল্লাহর উপর ভরসাকে।
একটি ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধ
খাজা পরিবার কখনোই সন্তানদের অন্যায়, জুলুম, অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের শিক্ষা দেয়নি। পারিবারিক শিক্ষায় বারবার বলা হয়েছে — "যুলুম করো না, যুলুম সহ্য করো খোদার সন্তুষ্টির জন্য"। এভাবেই প্রতিটি প্রজন্মকে মাজলুমের পক্ষে দাঁড়াতে শিখানো হয়েছে।
তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যজুড়ে রয়েছে কুরআনের শিক্ষা, হাদীসের অনুসরণ, পীর-মাশায়েখদের আদর্শ অনুসরণ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা। খাজা পরিবারের সন্তানরা হয়েছেন জ্ঞানী,আল্লাহ প্রেমিক,সুফী সাধক, দানবীর কিংবা সমাজ সংস্কারক। অর্থনীতি, ধর্মনীতি ও মানবকল্যাণে তাঁরা আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন।
জ্ঞানে ও দানে অগ্রগামী
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই পরিবার জ্ঞান ও দানের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতা রক্ষায় অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে। জ্ঞানচর্চা কেবল একটি পারিবারিক অভ্যাস নয়, বরং একটি ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হতো। ‘সদকা-ই-জারিয়া’র অংশ হিসেবে তাঁরা মসজিদ, মাদ্রাসা, হসপিটাল এবং পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে সক্রিয় থেকেছেন।
তাঁরা বিশ্বাস করতেন, “জ্ঞান হলো একমাত্র পুঁজি যা দান করলে বাড়ে”।
খাজা পরিবার শুধু একটি আভিজাত্যশালী পরিবার নয়, বরং এক অনন্য সুফী-ঐতিহ্য বহনকারী আত্মিক বংশ। যুগে যুগে তাঁরা বারবার প্রমাণ করেছেন, ইসলামি সভ্যতার শ্রেষ্ঠ গুণাবলি যেমন – ন্যায়, দান, মেহমানদারি, সহনশীলতা, প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ ও আত্মবিশ্বাস—এসব তাঁদের অন্তর্গত মূল্যবোধ।
এই পরিবারের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাই এক অমলিন বিশ্বাসের ধারা, যেখানে ধর্ম ও সমাজ সমান্তরালে চলেছে। এমন একটি পরিবার হারিয়ে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও কীর্তিগুলো আজও বেঁচে থাকে আমাদের মাঝে।
পরিশেষে বলা যায়—খাজা ফয়জুদ্দীন ছাহেব (রহঃ) এই পরিবারকে শুধু উত্তরাধিকারসূত্রে নয়, বরং আদর্শিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর পূর্বসূরী আল্লামা শাহসুফী খাজা ছলেমউদ্দীন (রহঃ) ও তাঁর উত্তরসূরী মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ)-এর মধ্যে যে আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন ছিলো, তা কেবল বংশ নয়, বরং আল্লাহর রহমত ও তাঁদের নেক নিয়ত–এর পরিণতি।
এই আত্মিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করেই খাজা পরিবার যুগে যুগে জনকল্যাণে, সাম্য-ভ্রাতৃত্বে ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক সমাজ গঠনে এক নিরব কিন্তু সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করে গেছে।
১২৪ বার পড়া হয়েছে