বাংলাদেশে মদিনা সনদভিত্তিক শাসনব্যবস্থা: বাস্তবতা কতটা সম্ভব?
সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০২ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন সক্রিয় জামায়াতে ইসলামী সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মডেল হিসেবে মদিনা সনদের নাম বেশি করে সামনে আনছে।
দলটির শীর্ষ নেতারা বক্তব্যে দাবি করছেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রণীত এই সনদ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে দেশে ন্যায়বিচার, সাম্য, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও “প্রকৃত গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোথাও আজ মদিনা সনদের ধারাগুলো হুবহু অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না; দলিলটি মূলত নৈতিক ও তাত্ত্বিক মডেল হিসেবে আলোচনা হয়, কার্যকর সংবিধান হিসেবে নয়। ফলে “মদিনা সনদভিত্তিক” শাসনব্যবস্থা বাস্তবে কতটা প্রয়োগযোগ্য—এ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে।
মদিনা সনদকে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সংবিধানধর্মী রাজনৈতিক-সামাজিক চুক্তি হিসেবে ধরা হয়, যা ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে হিজরতের পর মদিনায় বহুধর্মীয়, বহু-গোত্রীয় সমাজকে এক রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় আনার জন্য প্রণীত হয়। এতে একদিকে মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসারদের মধ্যকার সম্পর্ক, অন্যদিকে ইহুদি ও অন্যান্য অমুসলিম গোত্রের সঙ্গে মুসলিমদের অধিকার-দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়; গবেষণায় দলিলটিতে প্রায় ৪০–৫০টি ধারা থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
এই সনদের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) মদিনাকে একটি বহুধর্মীয় নগররাষ্ট্র হিসেবে পরিচালনা করেন, যেখানে তিনি একই সঙ্গে রাসুল, রাজনৈতিক নেতা, বিচারক ও সেনাপতি হলেও শাসনব্যবস্থাকে চুক্তিনির্ভর ও অংশীদারিত্বমূলক রেখেছেন। সনদে তাকে বিরোধের চূড়ান্ত সালিশ ও সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে ইহুদি ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে তাদের ধর্ম, উপাসনা ও আভ্যন্তরীণ আইনের ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় সবাইকে যৌথভাবে দায়বদ্ধ করা হয়। গবেষকরা এটিকে এক ধরনের প্রাথমিক সামাজিক চুক্তি ও প্লুরালিস্ট রাজনৈতিক মডেল হিসেবে দেখেন, যেখানে আইনের শাসন, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা, সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও যৌথ প্রতিরক্ষা—এসব নীতি বাস্তবভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ থাকলেও, পরবর্তীকালে এতে “আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। আইন, প্রশাসন, নির্বাচন, মৌলিক অধিকার, আদালতব্যবস্থা—সব মিলিয়ে এটি একটি আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক কাঠামো, যা আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার সনদ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথেও যুক্ত। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কেউ “মদিনা সনদভিত্তিক শাসনব্যবস্থা” চালুর কথা বলে, তা কার্যত বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর এক মৌলিক রূপান্তর বা পুনর্লিখনের দাবি, যা কেবল রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থেকে সুস্পষ্ট খসড়া ও আইনি বিশ্লেষণ দাবি করে।
ইসলামী আইন ও রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে কোনো আধুনিক জাতিরাষ্ট্র মদিনা সনদকে হুবহু কার্যকর সংবিধান হিসেবে চালু করেনি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরকি, টিউনিসিয়াসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বহু দেশে ধর্মীয় বহুত্ববাদ, সংখ্যালঘু অধিকার ও নাগরিকত্বের ধারণা ব্যাখ্যা করতে মদিনা সনদকে ঐতিহাসিক মডেল হিসেবে টানা হয়, কিন্তু তাদের সংবিধান ফরাসি, ব্রিটিশ, অটোমান, উপনিবেশিক ও আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন প্রভাবিত স্বতন্ত্র কাঠামো। ফলে “পৃথিবীর কোথাও নেই, কিন্তু বাংলাদেশে করব”—এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যকে অনেক পর্যবেক্ষক আদর্শগত স্লোগান বলে অভিহিত করছেন, বাস্তবায়নযোগ্য নীতি-প্রস্তাব হিসেবে নয়।
মদিনা সনদ ঐতিহাসিকভাবে একটি নগররাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্র ও ধর্মের মধ্যে স্বাক্ষরিত রাজনৈতিক চুক্তি; সেখানে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, মৌলিক অধিকার অধ্যায়—এসব আধুনিক কাঠামো নেই। বাংলাদেশের সংবিধান এসব বিশদ কাঠামো নির্ধারণ করেছে; ফলে মদিনা সনদকে “মডেল” বলা গেলেও, সরাসরি “বিকল্প সংবিধান” হিসেবে বসানো বাস্তবে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করতে পারে।
নবী (সা.)-এর শাসনে মদিনা সনদ বহুধর্মীয় উম্মাহ গঠন করে ইহুদি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল; আজকের বাংলাদেশে কোন দল কীভাবে “অমুসলিম নাগরিকের অধিকার” নির্ধারণ করবে—এ নিয়ে স্বচ্ছ নীলনকশা তাদের কর্মসূচিতে স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ, বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তির অংশ; মদিনা সনদের ঐতিহাসিক ধারাগুলোর সঙ্গে এসব আধুনিক আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার সম্পর্ক কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সে প্রশ্নও অমীমাংসিত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, মদিনা সনদের প্রকৃত শক্তি হলো এর নৈতিক ভিত্তি—ন্যায়বিচার, সংখ্যালঘু সুরক্ষা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও যৌথ নিরাপত্তা—যা আজকের বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও গ্রহণযোগ্য মূল্যবোধ। কাজেই এই আদর্শগুলোকে বর্তমান সংবিধান ও আইনি ব্যবস্থার ভেতরে কীভাবে রূপান্তর করা যায়—সে বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা হওয়া জরুরি, কিন্তু মদিনা সনদকে ২১ শতকের জন্য “রেডিমেড ব্লুপ্রিন্ট” হিসেবে তুলে ধরলে বাস্তবতা ও ইতিহাস উভয়ই বিকৃত হয়।
মদিনা সনদকে সামনে রেখে জামায়াতের নারী প্রার্থী না দিয়ে হিন্দু প্রার্থী দেওয়া—এটি মূলত দলটির নির্বাচনী কৌশল ও আদর্শিক বাছাইয়ের বৈপরীত্যকে স্পষ্ট করে, কারণ মদিনা সনদে অমুসলিমদের নাগরিক অংশীদারত্ব ও নিরাপত্তা স্বীকৃত হলেও নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কোনো সরাসরি নিষেধ নেই; বরং ঐতিহাসিকভাবে মদিনা সমাজে নারী অর্থনীতি, শিক্ষা ও জনজীবনে সীমাবদ্ধ হলেও সক্রিয় উপস্থিতি রেখেছিল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে আজকের প্রেক্ষাপটে যদি কোনো দল মদিনা সনদকে “প্লুরালিজম” ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের মডেল হিসেবে ব্যবহার করে, অথচ নারীকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রেই ধর্মীয় ব্যাখ্যার অজুহাতে বাদ দেয় কিন্তু সংখ্যালঘু (হিন্দু) প্রার্থী দেয়, তাহলে তা মদিনা সনদের মূল চেতনা—অংশীদারিত্ব, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিকত্ব—এর সঙ্গে ধারাবাহিক নীতিগত অনুসরণ নয়, বরং নির্বাচনী ও আদর্শিকভাবে বাছাই করা ব্যবহার (selective use) হিসেবে প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনেকের মত, যদি কোনো দল সত্যিই মহানবী (সা.)-এর মদিনা সনদ অনুযায়ী শাসনের আদর্শ অনুসরণ করতে চায়, তাহলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত—দলীয় গণতন্ত্র, জনগণের মতামতের প্রতি সম্মান, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; কারণ মদিনা সনদের বাস্তব প্রয়োগে নবী (সা.)—এগুলোই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কেবল স্লোগান নয়। তাই “বাংলাদেশে মদিনা সনদভিত্তিক শাসনব্যবস্থা” ধারণাটি নৈতিক আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হলেও, এটিকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র মডেল হিসেবে বাস্তবায়ন করার প্রশ্নে যথেষ্ট তাত্ত্বিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রস্তুতি এখনো অনুপস্থিত বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২৪ বার পড়া হয়েছে