সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে
রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫ ৭:১১ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
ঢাকায় কিছু ইসলামি দল সমাবেশ করে দাবী তুলেছে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার জন্য। দাবীটা জানিয়েছে সরকার ও রাষ্ট্রের কাছে। সমাবেশে অংশ নিয়ে সায় দিয়ে এসেছে বিএনপি ও জামায়াত।
বিএনপি ও জামায়াত কেন গেল - এ প্রসঙ্গে যাবার আগে বলছি, আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষনার এই উস্কানিমূলক দাবী অগ্রহণযোগ্য এবং নতুন করে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপপ্রয়াসের গভীর ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শুভবোধসম্পন্ন মানুষ এই দাবীর প্রতি সমর্থন দিতে পারে না। সরকার বা রাষ্ট্র পারে না কারো ধর্ম কি হবে, ভুল ও সঠিকতা ঠিক করে দিতে। গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় দলগুলোও পারে না কে মুসলিম, কে অমুসলিম তা নির্ধারণ করার। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও চর্চার। প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার দিয়েছে সংবিধান। সংবিধানের ৪১ ধারা অনুযায়ী আহমদিয়াদের ধর্ম পালন, চর্চা বা প্রচারের অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রয়েছে। এমন কি জুলাই সনদের ৭ নং ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতাকে শুধু মৌলিক অধিকার হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।মাত্র ক'দিন আগে এই সনদে আবার স্বাক্ষর করে এসেছে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত ইসলামী, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও জমিয়তে উলায়মা ইসলামসহ সকল ইসলামপন্থী দল। সমাবেশে এরা যখন সম্মিলিতভাবে কোন সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবী তুলে তখন এরা জুলাই সনদকে শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়নি, জাতির সাথে মোনাফেকি করেছে।
এবার আসি সমাবেশে কেন বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ করে একাত্মতা প্রকাশ করলো। জামায়াতের কথা বাদ। কারণ এই দলটি মোনাফেক। তারপরও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তাদের গুরু মাওলানা মওদুদী ১৯৫৩ সালের কাদিয়ানী (আহমদীয়া) বিরোধী দাঙ্গার সাথে জড়িত ছিলেন। এই দাঙ্গাগুলি ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে শুরু হয়েছিল এবং মে মাস পর্যন্ত চলেছিল, প্রধানত পাকিস্তানের লাহোরে। এই দাঙ্গার উস্কানির অভিযোগে পাকিস্তানের সামরিক আদালত মওদুদীকে ১৯৫৩ সালের মে মাসে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিল। তবে, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রাষ্ট্রের চাপের কারণে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরবর্তীকালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৫৫ সালে মুক্তি পান। এই দাঙ্গার মূল দাবি ছিল আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করা এবং মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খানের মতো শীর্ষ সরকারি পদ থেকে আহমদীয় সম্প্রদায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণ করা। মওদুদী "কাদিয়ানী মাসআলা" নামে একটি বই লিখে এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে চেয়েছিলেন, যা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই জামায়াত যে এই সমাবেশ যাবে এটাই স্বাভাবিক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করবে?
হিসাব পরিস্কার। গত আঠারো মাসে সারাদেশে চাঁদাবাজি, দখল বানিজ্যে জড়িয়ে বিএনপি'র নেতাকর্মীরা দলের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা ধ্বংস করেছে। ৫ আগস্টের পূর্বের যে জনপ্রিয়তা ছিল বিএনপির এখন আর তা নেই। আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া কঠিন করে তুলেছে দলটির একশ্রেণীর নেতাকর্মীরাই। ক্ষমতায় যেতে হলে বিএনপিকে ইসলামি দল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মন জয় করতে হবে, হয়ত এই কৌশল নিয়ে বিএনপিকে মোকাবেলা করতে হবে আগামী নির্বাচনে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠা জামায়াতকে। অথচ ৫ আগস্টের আগে এবং বলা যায় পুরো আগাস্ট মাস পর্যন্ত ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে নির্ভার ও নিশ্চিত থাকা দলটি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের যদি সামাল দিতে পারত, তবে আজকে এই কৌশল নিতে হতো না । এই কৌশল বিএনপির জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণই হবে। দলটির সরাসরি সমর্থক নয় কিন্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার লক্ষ লক্ষ মানুষ ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের সমর্থন দিয়েছে। এই নিরব সুইং ভোট হারানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময় দেশে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের এই উস্কানি রুখতে বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক ও বাম চেতনায় বিশ্বাসী অপরাপর রাজনৈতিক দল এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ঐক্যবদ্ধ না হলে দেশে বিভেদ মারাত্মক আকার শুধু ধারণই করবে না, ইসলামী ফ্যাসিবাদ ভয়ংকর হয়ে উঠবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ।
১১৩ বার পড়া হয়েছে