কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস: আঞ্চলিক বিজয় থেকে জাতীয় আত্মবিশ্বাসের উৎস
বৃহস্পতিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩:২৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ঐতিহাসিক ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস শুধু একটি জেলার শত্রুমুক্ত হওয়ার দিন নয়, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক গতিপথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ, গণঅংশগ্রহণ, মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সমন্বিত অভিযান এবং আগাম বিজয়ের প্রতীক—সব মিলিয়ে কুষ্টিয়ার মুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্যায়েই কুষ্টিয়ায় সংঘটিত প্রতিরোধ যুদ্ধগুলো গোটা দেশের মানুষের মানসিকতায় বড় ধাক্কা ও নতুন সাহস এনে দেয়। ৩০ মার্চের সম্মুখযুদ্ধসহ পরবর্তী কয়েকটি অভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্যদের বিপরীতে তুলনামূলকভাবে স্বল্প অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় কুষ্টিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ। এই যুদ্ধগুলো প্রমাণ করে, শাসকগোষ্ঠীর “অপরাজেয় সেনাবাহিনী” আসলে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে দুর্বল হতে বাধ্য—এ ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্য অঞ্চলেও। ফলে কুষ্টিয়ার মাটিতে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের জন্য মানসিক ও রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
আঞ্চলিকভাবে কুষ্টিয়ার মুক্তি একটি আগাম বিজয়ের প্রতীক। জাতীয় পর্যায়ে বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর হলেও, কুষ্টিয়াবাসী সেই গৌরবের স্বাদ পায় এর পাঁচ দিন আগেই। শত্রুমুক্ত ঘোষণা, পতাকা উত্তোলন এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে যাওয়া—এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ পশ্চিমাঞ্চলের অন্য জেলা, বিশেষ করে কুষ্টিয়া–ঝিনাইদহ–চুয়াডাঙ্গা–মেহেরপুর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে। একই সঙ্গে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ভেঙে পড়ায় তাদের সরবরাহ ও পুনর্গঠন উভয়ই ব্যাহত হয়, যা জাতীয় বিজয়ের পথকে আরও ত্বরান্বিত করে।
কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এখানে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে একেবারে “জনযুদ্ধের” মডেলে। সংগঠিত মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি ইপিআর ও পুলিশের বিদ্রোহী সদস্য, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক–পেশাজীবী—সবাই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের অংশ হয়ে ওঠে। কেউ সরাসরি অস্ত্র হাতে ফ্রন্টলাইনে, কেউ গেরিলা অভিযানে গাইড, কেউ আবার আশ্রয়দাতা, রসদদাতা বা তথ্যদাতা হিসেবে। শহর–গ্রামের সাধারণ মানুষ সড়ক-ব্রিজ কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, পাকবাহিনীর চলাচলের ওপর নজর রাখা, হানা দেওয়ার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করা—এসব কাজে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ফলে কুষ্টিয়ার লড়াই শুধু সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সামরিক কমান্ড আর জনগণের এক সমন্বিত প্রতিরোধের বাস্তব উদাহরণ।
সামরিক ইতিহাসের দৃষ্টিতে কুষ্টিয়ার যুদ্ধ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলিতভাবে পাকবাহিনীর ক্যাম্প, ব্রিজ, রেললাইন ও রসদ সরবরাহ লাইনের ওপর সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। স্থানীয় ভূপ্রকৃতি ও জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের যে কৌশল প্রয়োগ হয়, তা পরবর্তীকালে সামরিক বিশ্লেষণে “দ্য ব্যাটেল অব কুষ্টিয়া” নামে আলোচিত হয়েছে। কুষ্টিয়ার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, সীমিত সম্পদ নিয়েও সঠিক কৌশল, ভূগোলের ব্যবহার এবং জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে তুলনামূলক শক্তিশালী বাহিনীকেও পরাজিত করা সম্ভব।
কুষ্টিয়া মুক্ত দিবসের আরেকটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে স্মৃতি, পরিচয় ও স্থানীয় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। এ দিনটি ঘিরে প্রতিবছর শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ, র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রজন্মান্তরে গল্প বলা—সব মিলিয়ে কুষ্টিয়ার মানুষ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধ-অভিজ্ঞতাকে সচেতনভাবে বাঁচিয়ে রাখে। শহীদ পরিবার, নির্যাতিত নারী, জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখের বর্ণনা নতুন প্রজন্মের কাছে শুধু অতীতের গল্প নয়, ন্যায়বিচার, প্রতিরোধ ও মানবিক মর্যাদার পাঠ হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিক স্মৃতিচর্চা কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক পরিচয়কে দৃঢ় করে, আবার একই সঙ্গে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে এই অঞ্চলের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে।
সব মিলিয়ে কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস শুধু একটি তারিখ বা আনুষ্ঠানিক দিবস নয়; এটি প্রমাণ করে, কোনো সংগ্রামে প্রান্তিক মনে হওয়া এক জেলা কখনও কখনও গোটা জাতির আত্মবিশ্বাস, সামরিক কৌশল আর রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। কুষ্টিয়ার মুক্তি তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভৌগোলিক এক অধ্যায় নয়, বরং শেখায়—একটি অঞ্চল সংগঠিত হলে, পুরো দেশের মুক্তির ইতিহাস বদলে যেতে পারে।
১২০ বার পড়া হয়েছে