সর্বশেষ

জাতীয়আজ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা
রাতেই দপ্তর থেকে বের হয়েছেন উপদেষ্টা, আজ প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা  মাহফুজ ও সজীব ভুঁইয়ার পদত্যাগ
সারাদেশরাজশাহীতে ক্যামেরায় ধরা পড়েনি গর্তে পড়া শিশুটি, এখনও চলছে উদ্ধারকাজ
আন্তর্জাতিকমস্কোর কাছে রুশ সামরিক কার্গো বিমান বিধ্বস্ত, ৭ জনের মৃত্যু
খেলাএবারের আইপিএল নিলামে থাকছেনা পাঁচ তারকার উপস্থিতি
মতামত

রবি শংকর: সেতারের তারে স্বাধীনতার সুর

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বৃহস্পতিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩:০৮ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
১৯৭১ সাল—বাংলার বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ, নদীতে ঝরছে রক্ত, আর মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের স্বাধীনতার আকুতি।

পৃথিবীর এক প্রান্তে চলছে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ, আর অন্য প্রান্তে, লন্ডন-নিউইয়র্কের মঞ্চে এক সেতারবাদক সেই আর্তনাদকে রূপ দিচ্ছেন বিশ্বমানবতার সুরে। তিনি পণ্ডিত রবি শংকর—ভারতের সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি তখন বাংলাদেশ নামের এক অচেনা দেশের জন্য হৃদয় উজাড় করে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বমঞ্চে নীরবতা ছিল প্রবল। রাজনৈতিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব তখন পাকিস্তানের পক্ষে। লাখো শরণার্থী যখন আশ্রয় নিচ্ছে ভারতের সীমান্তে, তখন বিশ্বের সংবাদপত্রগুলোও মানুষ হত্যার খবরগুলোকে উপেক্ষা করছে। এই সময়েই মানবতার পক্ষের এক শিল্পী নিজের সুরকে পরিণত করেছিলেন প্রতিবাদের ভাষায়।

রবি শংকরের জন্ম ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে বারাণসীতে, এক শিল্পপ্রবণ পরিবারে। কৈশোরেই ইউরোপ ভ্রমণ শুরু হয় নৃত্য ও সংগীতসন্ধানী এই প্রতিভার। পরে সেতারের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয়। তাঁর সুর শুধু ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিচায়ক হয়নি, এটি হয়ে উঠেছিল পূর্বের ভাবজগতের এক বিশ্বভাষা। তিনি যখন সেতার তোলেন, তখন মনে হয় আঙুলের সঙ্গে সুরও প্রার্থনা করছে।

এই সংগীতগুরু মুক্তিযুদ্ধের বছর নিউইয়র্কে অবস্থানকালে জানতে পারেন বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে। বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা ও হত্যাযজ্ঞের ছবি দেখে তিনি গভীরভাবে বিচলিত হন। সহকর্মী এবং বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে (বিটলসের প্রাক্তন সদস্য) তিনি বলেন, “জর্জ, কিছু করতে হবে।” সেই এক বাক্য থেকেই ইতিহাস রচিত হয়—“Concert for Bangladesh” নামে পৃথিবীর প্রথম মানবিক ত্রাণ কনসার্ট।

১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের মঞ্চে অভিনেতা, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক—সবাই একত্র হয়েছিল এক সাধারণ উদ্দেশ্যে: বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো। রবি শংকর সেদিন নিজের সেতারের সুরে শুরু করেন অনুষ্ঠান। প্রথমেই তিনি শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন, “আমার দেশের মানুষ আজ অমানবিক কষ্টে আছে; আমরা আজ সংগীত বাজাবো তাদের জন্য।” সেই কথার পরেই পৃথিবীর শ্রোতাদের চোখে অশ্রু আর মনে সাড়া পড়ে যায়।

মঞ্চে জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, বিলি প্রেস্টনসহ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা একত্র হন। “Bangladesh” শব্দটি প্রথমবার তখন গিটার, ড্রাম ও সেতারের সুরে মিলেমিশে উচ্চারিত হয় সারা পৃথিবীতে। কনসার্টে সংগৃহীত অর্থ যায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে, আর তার চেয়েও বড়—পৃথিবীর সংবাদমাধ্যম প্রথমবার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কথা উচ্চারণ করে সহমর্মিতার সঙ্গে।

রবি শংকরের ভূমিকা শুধু একজন শিল্পী বা আয়োজকের নয়; তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক নায়কের প্রতীকি রূপ। সংগীতের মতো কোমল শিল্পরূপকে তিনি মানবতার অস্ত্রে রূপান্তর করেছিলেন। তাঁর বাজনা, তাঁর কথন, আর তাঁর উপস্থিতি—সবই জানিয়েছিল, শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল বন্দুকের নয়, তা হতে পারে সুরেরও।

অনেক পশ্চিমা সমালোচক পরে বলেছেন, “Concert for Bangladesh changed the way we see a humanitarian crisis.” আসলেই, রবি শংকর সেই পরিবর্তনের প্রথম সুর বাঁধেন। তাঁর সহানুভূতি আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রাচীর ভেঙে প্রকাশ করে দেয়, এক শিল্পীর নৈতিক অবস্থান কতটা শক্তিশালী হতে পারে।

রবি শংকরের জীবনজুড়ে ছিল শিল্প, ন্যায় ও মানবতার মেলবন্ধন। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের দিন তিনি হয়তো উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু তাঁর সুর সেই জন্মের সহযাত্রী ছিল। তিনি যে সেতার বাজিয়েছিলেন ওই আগস্টের রাতে, তা যেন হয়ে উঠেছিল বাংলার রোদে পোড়া চামড়ায় সহানুভূতির বৃষ্টি।

২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর আজকের দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর সঙ্গীত এখনো বাজে—ঢাকার কোনো স্টুডিওতে, কলকাতার রেডিও স্টেশনে বা লস অ্যাঞ্জেলেসের কোনো কনসার্ট হলে। সেই সুরের প্রতিধ্বনিতে এখনো লুকিয়ে আছে এক দেশের মুক্তির স্মৃতি।

বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় রবি শংকরের নাম লেখা নেই কোনো যুদ্ধজয়ের তালিকায়, কিন্তু তিনি সেই তালিকার বাইরের এক যোদ্ধা—যিনি দেখিয়েছেন, শিল্প মানে মানবতার প্রতি অঙ্গীকার। রবি শংকরের সুরে বাংলাদেশের মুক্তির চেতনা আজো বেজে ওঠে—নীরবে, গর্বে, কৃতজ্ঞতায়।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১১৭ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন














সর্বশেষ সব খবর
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন