আন্তর্জাতিক রাজনীতি, পারমাণবিক অস্ত্র ও বিচার: ন্যায়বিচার নাকি শক্তির দ্বৈত মানদণ্ড?

সোমবার, ২৩ জুন, ২০২৫ ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে “ন্যায়বিচার”, “আইন” ও “নৈতিকতা” কতটা বাস্তব, আর কতটা প্রতীকী—এ প্রশ্ন আজকের বিশ্বে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।
বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র, যুদ্ধাপরাধ, আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক-ইরান-ইসরাইল সংঘাতের আলোকে এই প্রশ্নগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
আজকে এই প্রতিবেদনে আমরা খুঁজে দেখব—কেন আন্তর্জাতিক আইন বারবার শক্তির কাছে পরাজিত হয়, কেন কিছু দেশ বা নেতা বিচারের মুখোমুখি হয়, কেউ হয় না, এবং এই দ্বৈত মানদণ্ডের ফলে বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতা কতটা দুরূহ।
ইরাক ও ইরান: পারমাণবিক অস্ত্রের অভিযোগ, যুদ্ধ ও বাস্তবতা
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাকের বিরুদ্ধে “গোপন পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি”–এর অভিযোগ তুলে সাদ্দাম হোসেনের সরকার উৎখাত করে। যুদ্ধের পর দেখা গেল, ইরাকের পারমাণবিক কর্মসূচি ১৯৯১ সালের পর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; কোনো অস্ত্রের মজুত পাওয়া যায়নি। অথচ গোয়েন্দা তথ্যের ভুল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও কৌশলগত স্বার্থে পুরো একটি দেশ ধ্বংস হয়ে গেল, লাখো মানুষ নিহত, বাস্তুচ্যুত ও নিপীড়িত হলো।
আজ একই অভিযোগে ইরানকে টার্গেট করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, অথচ আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) বারবার বলেছে—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, এমন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।
প্রশ্ন ওঠে—এই “অস্ত্রের অভিযোগ” কি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নাকি আঞ্চলিক আধিপত্য, তেল সম্পদ ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য? বাস্তবতা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের লক্ষ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে দুর্বল রাখা, নিজেদের আধিপত্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করা।
শক্তির দ্বৈত মানদণ্ড: আইন কি কেবল দুর্বলদের জন্য?
আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ, NPT, জেনেভা কনভেনশন—সবই যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে কঠোর। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে এসব আইনকে উপেক্ষা করে, আবার দুর্বল দেশ বা শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রয়োগ করে।
ইরাকের বিরুদ্ধে “অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে” যুদ্ধ, ইরানে “প্রতিরোধমূলক হামলা”, আবার ইসরাইলের গাজায় নির্বিচার আগ্রাসন—সবই এই দ্বৈত মানদণ্ডের দৃষ্টান্ত।
যখন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার, যেমন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতাবোধের চরম লঙ্ঘন, তখনও বিজয়ী শক্তির বিচার হয় না। বরং জাপানকে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
“বিচার” কি কেবল পরাজিত ও দুর্বলদের জন্য? শক্তিধর দেশ বা তাদের মিত্রদের জন্য কি আইনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই?
আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা: ন্যায়বিচার নাকি প্রতীকী চাপ?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ)–এর মতো সংস্থা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা আবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
২০২৪ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী গালান্টের বিরুদ্ধে ICC গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে—এটি নিঃসন্দেহে ইতিহাসে নজিরবিহীন। কিন্তু বাস্তবে, আইসিসির নিজস্ব কোনো বলপ্রয়োগ ক্ষমতা নেই, সদস্য রাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হয়। “এটা কি দন্তহীন বাঘের হুংকার ছাড়া আর কিছু?”।
বাস্তবে, আইসিসি বা ICJ-এর এই পদক্ষেপগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না, তবে আন্তর্জাতিকভাবে “অপরাধী” হিসেবে চিহ্নিত করে, নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।
তবুও, ইতিহাস বলছে—শক্তিধর দেশ বা তাদের মিত্রদের বিরুদ্ধে এই চাপ খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন—তারা ICC-এর সদস্যই নয়, এবং নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ মানে না। ইসরাইলও একই পথ অনুসরণ করছে।
পারমাণবিক অস্ত্র: অপরাধ, নাকি নিরাপত্তার হাতিয়ার?
আন্তর্জাতিক আইন পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার, ব্যবহার ও সরবরাহকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। NPT, TPNW, জেনেভা কনভেনশন—সবই পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে।
কিন্তু বাস্তবে, “পারমাণবিক শক্তিধর” দেশগুলো নিজেরা অস্ত্র মজুদ রাখে, আবার অন্যদের নিষিদ্ধ করে।
ICJ-এর ১৯৯৬ সালের মতামতে বলা হয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সাধারণত অবৈধ, তবে “রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার” জন্য সীমিত ক্ষেত্রে আইনি যুক্তি থাকতে পারে।
এখানেই সবচেয়ে বড় দ্বিচারিতা—শক্তিধর দেশগুলো নিজেদের অস্তিত্বের জন্য পারমাণবিক অস্ত্রকে বৈধতা দেয়, আবার অন্যদের জন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।
“কিছু দেশ কেন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারকে অপরাধ মনে করে না?” আইনের অস্পষ্টতা, শক্তির ভারসাম্য, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক স্বার্থ, এবং “বিজয়ীর বিচার”–এর ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
গাজা, ইসরাইল ও যুদ্ধাপরাধ: বিচার কি সম্ভব?
গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলছে।
আইসিসি নেতানিয়াহু ও গালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে; ICJ-এ গণহত্যার মামলা চলছে।
যদি যুদ্ধাপরাধের জন্য জাপানের বিচার হতে পারে, তাহলে ইসরাইলেরও হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, বেসামরিক জনগণের ওপর নির্বিচার হামলা, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার—সবই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
তবে বাস্তবে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, এবং আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট।
“জীবিত বা মৃত” পুরস্কার ঘোষণার মতো পদক্ষেপও সম্ভব নয়, কারণ নেতানিয়াহু এখনো বৈধ রাষ্ট্রপ্রধান এবং পশ্চিমা বিশ্বের মিত্র। এখানেও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার শক্তির কাছে পরাজিত—এটাই বাস্তবতা।
যুদ্ধাপরাধ, বিচার ও আন্তর্জাতিক আইন: ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক আইন, বিচার ও ন্যায়বিচার আজও শক্তি, রাজনীতি ও দ্বৈত মানদণ্ডের কাছে অসহায়।
যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার—সবই আইনে অপরাধ, কিন্তু বিচার হয় কেবল দুর্বলদের, শক্তিধরদের নয়।
আইসিসি, ICJ-এর মতো সংস্থাগুলো প্রতীকী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও, বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই।
তবুও, এই প্রতীকী চাপ, নৈতিক বার্তা ও ইতিহাসে অপরাধীদের “অপরাধী” হিসেবে চিহ্নিত করার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আইন ও বিচারব্যবস্থার শক্তি বাড়ানো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি, এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা—এটাই মানবতার চ্যালেঞ্জ।
ন্যায়বিচার, শক্তি ও মানবতার দ্বন্দ্ব
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে “আইন” ও “ন্যায়বিচার” এখনও শক্তির দ্বৈত মানদণ্ডের কাছে পরাজিত। যুদ্ধাপরাধ, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার, মানবতাবিরোধী অপরাধ—সবই আইনে অপরাধ, কিন্তু বিচার কেবল দুর্বলদের জন্য।
শক্তিধর দেশ ও তাদের মিত্ররা নিজেদের স্বার্থে আইনকে উপেক্ষা করে, আবার দুর্বলদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রয়োগ করে।
আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা প্রতীকী চাপ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষমতা সীমিত।
তবুও, ইতিহাস, নৈতিকতা ও মানবতার পক্ষে এই প্রতীকী ন্যায়বিচার গুরুত্বপূর্ণ—কারণ, একদিন হয়তো এই প্রতীকই বাস্তবায়নের পথ দেখাবে।
শেষ কথা
এখানে ন্যায়বিচার, আইন ও মানবতা বারবার শক্তি ও স্বার্থের কাছে পরাজিত। এই দ্বৈত মানদণ্ড ভেঙে সত্যিকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের মত কিছু অনুসন্ধানী ও সচেতন কণ্ঠই ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে আলো দেখাতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
২৪০ বার পড়া হয়েছে