নতুন বইয়ের আনন্দ ম্লান পদ্মার চরে, শিক্ষক সংকটে অনিশ্চিত হাজারো শিশুর শিক্ষা
মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
নতুন বছর মানেই নতুন বইয়ের উচ্ছ্বাস। আর কয়েক দিনের মধ্যেই বছরের প্রথম দিনে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পদ্মার চরের ২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছাবে নতুন পাঠ্যবই।
ঝকঝকে বইয়ের গন্ধে মুখর হবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। কিন্তু সেই আনন্দের মধ্যেই দীর্ঘদিনের তীব্র শিক্ষকসংকট চরের শিশুদের শিক্ষাজীবনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের পদ্মার চরের ২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুমোদিত শিক্ষক পদ ১৫০টি হলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৮৫ জন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ৬৫টি শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বিদ্যালয় সূত্রের ভাষ্য, দুর্গম চরাঞ্চলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ পেলেও যাতায়াত ও আবাসন সমস্যার কথা তুলে ধরে অনেকেই সেখানে দীর্ঘদিন থাকতে চান না। অল্প সময়ের মধ্যেই নানা সুপারিশে তাঁরা সুবিধাজনক এলাকায় বদলি হয়ে যান। প্রতিবছর শিক্ষক নিয়োগ হলেও দুর্গম এলাকায় শিক্ষক ধরে রাখার জন্য কার্যকর নীতিমালা বা প্রণোদনার অভাবে সংকট বছরের পর বছর থেকেই যাচ্ছে।
সরেজমিনে চরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক স্কুলে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টি শ্রেণির বিপরীতে মাত্র দুই থেকে তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। কোথাও আবার একজন শিক্ষককেই পুরো বিদ্যালয়ের পাঠদান সামলাতে হচ্ছে। এক শিক্ষকের পক্ষে একসঙ্গে একাধিক শ্রেণিতে পাঠদান কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর ওপর অনেক শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করায় দাপ্তরিক কাজেই তাঁদের অধিকাংশ সময় ব্যয় হচ্ছে।
চিলমারী ইউনিয়নের খারিজাথাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিন বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসে নিয়মিত দাপ্তরিক কাজে যেতে হয়। দুর্গম চরাঞ্চল পাড়ি দিয়ে যাওয়া-আসাতেই পুরো দিন শেষ হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকে।
চর থেকে উপজেলা সদরে একজন শিক্ষকের যাতায়াতে গড়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। এতে খরচ হয় প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে মোটরসাইকেলই ভরসা। নারী শিক্ষকদের জন্য এই যাতায়াত আরও কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।
পূর্ব খারিজাথাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পারভিনা আক্তার জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে ৩৬৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র তিনজন শিক্ষক পাঠদান করছেন। প্রতিটি শ্রেণিতে গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ জন শিক্ষার্থী। তিনি বাইরে থাকলে মাত্র দুজন শিক্ষক দিয়ে পুরো বিদ্যালয় চালাতে হয়। তাঁর ভাষায়, “এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কী মানের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েই শঙ্কা।”
শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকসংকটের ভোগান্তির কথা জানায়। রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সোনাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, শিক্ষক কম থাকায় অনেক সময় ক্লাস হয় না, আবার ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে বসতে হয়।
অভিভাবকদের ক্ষোভ আরও তীব্র। আব্দুর রাজ্জাক নামের এক অভিভাবক বলেন, “সন্তানের হাতে নতুন বই আছে, কিন্তু মাথার ওপর শিক্ষক নেই। শহরের স্কুলে শিক্ষক ভরপুর, অথচ চরের শিশুদের জন্য কেন স্থায়ী ব্যবস্থা নেই?”
অভিভাবকদের অভিযোগ, নিয়মিত পাঠদান না হওয়ায় চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষার মান দুর্বল হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে।
দৌলতপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুস্তাক আহম্মেদ বলেন, নতুন শিক্ষক এলেও অনেকেই চরাঞ্চলে থাকতে চান না। বিভিন্ন অজুহাতে তাঁরা সুবিধাজনক এলাকায় বদলি হয়ে যান। জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষক নিয়োগের কথা রয়েছে এবং চাহিদা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রের আশঙ্কা, নতুন শিক্ষক নিয়োগের পরও দায়িত্বে থাকা অনেক শিক্ষক স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন করলে সংকট দ্রুত কাটবে না।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, দৌলতপুর উপজেলায় ২১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮২টিতে প্রধান শিক্ষক নেই। এ ছাড়া ১ হাজার ১৬৬টি সহকারী শিক্ষক পদের বিপরীতে ১৩২টি পদ শূন্য রয়েছে, যার বড় অংশই পদ্মার চরাঞ্চলে।
নতুন বছরের নতুন বই হাতে পেলেও শিক্ষকসংকটের এই দীর্ঘশ্বাস পদ্মার চরের হাজারো শিশুর শিক্ষা ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে—এমনটাই মনে করছেন সচেতন মহল।
১৪৪ বার পড়া হয়েছে