জুলুমের দর্শন বনাম তওবার দর্শন: ফেরাউন থেকে শেখ হাসিনা
শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৮:০৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
মিশরের ফেরাউন থেকে শুরু করে সমকালীন বাংলাদেশ পর্যন্ত ইতিহাসের অনেক পর্বেই দেখা যায়—দীর্ঘদিনের জুলুম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর হঠাৎ কোনো এক পর্যায়ে ক্ষমতার পতন, আর তার আগে–পরে ঘন ঘন প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, ভূমিকম্প এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অনেকেই ফেরাউনি কাহিনির আলোকে পড়তে চাইছেন। কোরআনুল কারিম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতির পতনকে কেবল কাকতালীয় ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করে না; বরং “জুলুমের দর্শন” ও “তওবার দর্শন”–এই দুই বিপরীত পথের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরে। সুরা আর–রাদ, আয়াত ১১–তে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে—আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা বদলান না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভেতরের অবস্থা বদলে ফেলে।
পবিত্র কোরআনে জুলুমের দর্শন: ফেরাউনের কাহিনি
ফেরাউনের কাহিনি কোরআনে একাধিক সুরায় এসেছে, বিশেষভাবে সুরা আল–আ‘রাফ ও সুরা ইউনুস–হূদ–তাহা ইত্যাদিতে। সেখানে দেখা যায়, ফেরাউন শুধু একজন স্বৈরশাসক নন; তিনি জুলুমের একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শনের প্রতীক।
তিনি আল্লাহর রাসুল মূসা আলাইহিস সালামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন, নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসান, বনি ইসরাইলকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাসত্ব, হত্যাযজ্ঞ ও নারী–পুরুষের মর্যাদা হরণের মাধ্যমে দমন করেন।
সুরা আল–আ‘রাফ ৭:১৩৩ আয়াতে উল্লেখ আছে—ফেরাউন ও তার কওমের ওপর টানা কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাজিল করা হয়: প্লাবন/বন্যা, পঙ্গপাল, গুঁই–পোকা, ব্যাঙ ও রক্ত; এগুলোকে “স্পষ্ট নিদর্শন” বলা হয়েছে, কিন্তু তারা অহংকারে অটল থেকে গুনাহে লিপ্তই থাকে।
আরেক দিক থেকে, সুরা হূদে নূহ, আদ, সামূদ, লুত, শু‘আইব–এর কওমসহ একাধিক জাতির পতন বর্ণনা করে বলা হয়েছে—তারা নিজেরাই জুলুম ও ফাসাদে ডুবে গিয়ে ধ্বংস ডেকে এনেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি অবিচার করেননি। এর সারকথা—“জুলুমের দর্শন” মানে এমন এক রাজনৈতিক–সামাজিক মানসিকতা, যেখানে ক্ষমতা, সম্পদ ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য সত্যকে চেপে রাখা, দুর্বলদের পিষে ফেলা, এবং আল্লাহর নির্ধারিত ন্যায়বিচার অস্বীকার করাকে স্বাভাবিক করে নেওয়া হয়।
পবিত্র কোরআনে তওবার দর্শন: আল্লাহ অবস্থা বদলান কীভাবে?
সুরা আর–রাদ ১৩:১১ আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—তিনি কোনো কওমের অবস্থা বদলান না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের ভেতরের অবস্থা বদলিয়ে ফেলে। একই বক্তব্য আরেকভাবে এসেছে সুরা আল–আনফাল ৮:৫৩ আয়াতে—যে নিয়ামত আল্লাহ কোনো জাতিকে দিয়েছেন, তারা যখন নিজেরাই তা নষ্ট করে ফেলে, তখনই সেই নিয়ামত উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই দুই আয়াতে তওবার দর্শন পরিষ্কার হয়।
অবস্থা বদলানো মানে শুধু মুখে ইস্তেগফার পড়া নয়; বরং অন্যায়কে নীতি থেকে বাদ দেওয়া, জালিম কাঠামো ভেঙে ন্যায়ভিত্তিক কাঠামো গড়া।
যখন কোনো জাতি আল্লাহর আনুগত্য ও ইনসাফের পথ থেকে সরে গিয়ে পাপ, দুর্নীতি ও অবিচার–ভিত্তিক ব্যবস্থায় ঢুকে যায়, তখন আল্লাহ তাদের ওপর বিভিন্ন রকম “শিদ্দত” বা কষ্টের দরজা খুলে দেন—এটা কখনো শাস্তি, কখনো পরীক্ষা, কখনো সতর্কতা।
সুরা আল–বাকারা ২:১৫৫–এ বলা হয়েছে—ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন ও ফল–ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষায় ফেলা হবে; যারা সব অবস্থায় ধৈর্য ধরে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, তারাই সফল। অর্থাৎ দুর্যোগ ও বিপর্যয়কে কোরআন একদিকে পাপের পরিণাম, অন্যদিকে তওবা ও আত্মশুদ্ধির দরজা—দুই দিক থেকেই ব্যাখ্যা করে।
ফেরাউনের আযাব ও মিশরের দুর্যোগ
সুরা আল–আ‘রাফ ৭:১৩০–১৩৩–এ ফেরাউনের কওমের ওপর ধারাবাহিক খরা, ফসল নষ্ট হওয়া, প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্তের আযাবের কথা এসেছে; এগুলোকে “মুফাস্সালাত আয়াত” বা একের পর এক স্পষ্ট নিদর্শন বলা হয়েছে। তাফসিরবিদরা ব্যাখ্যা করেছেন:
এগুলো ছিল কেবল শাস্তি নয়, বরং একটার পর আরেকটা “সিগনাল”—তারা যেন জুলুম ছেড়ে আল্লাহর দিকে ও ন্যায়ের দিকে ফিরে আসে।
ফেরাউন–গোষ্ঠী বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুর্যোগ কেটে গেলে মিথ্যা দিয়ে ফিরে আসত, তাই শেষ পর্যন্ত সমুদ্র ডুবে মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত পরিণতি নেমে আসে।
এখানে স্পষ্ট হয়ে যায়—কোরআনিক ফ্রেমে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সরলভাবে “প্রকৃতির খেলা” বা “কেবল গজব”—দুইয়ের যেকোনো একটিতে ফেলে দেওয়া ঠিক নয়। এটা একই সঙ্গে জুলুমের ফলও হতে পারে, আবার তওবা–ও আত্মশুদ্ধির সুযোগও হতে পারে, নির্ভর করছে জাতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তার ওপর।
শেখ হাসিনা–উত্তর বাংলাদেশ
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকাল নিয়ে গুম–খুন, নিপীড়ন, দুর্নীতি, নির্বাচন কারচুপি, মানবাধিকার লঙ্ঘন—এমন বহু অভিযোগ দেশি–বিদেশি রিপোর্টে এসেছে। তার পতনের আগে–পরে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি ও ভূমিকম্প—এসবকে কেউ সরাসরি “ফাঁসির রায়ের গজব” বলে চালাতে চাইছে, কেউ আবার কেবল জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করছে। গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মত অনুযায়ী, বাংলাদেশের দুর্যোগঝুঁকি প্রধানত ভৌগোলিক অবস্থান, গ্লোবাল ও স্থানীয় জলবায়ু–নীতি, নদী–ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ–ধ্বংসের ফল।
কিন্তু একজন মুমিনের জন্য কোরআনিক প্রশ্নটি আলাদা:
সুরা আর–রাদ ১৩:১১ ও সুরা আল–আনফাল ৮:৫৩–এর আলোকে, আমরা কি স্বীকার করছি যে জাতি হিসেবে নিজের ভেতরের অন্যায়, দুর্নীতি, দলীয় দাসত্ব ও নীরব সমর্থন না বদলালে আল্লাহ আমাদের সমষ্টিগত অবস্থা বদলাবেন না?
সুরা আল–হাজ্জ ২২:৪৫–এ যেমন বহু জনপদের ধ্বংস, পরিত্যক্ত কূপ ও ভাঙা প্রাসাদের কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে, সেভাবে কি আমরা বুঝছি—জুলুম ও ফাসাদের ওপর দাঁড়ানো উন্নয়ন টেকসই নয়, বরং ধ্বংসের উপকরণ?
এই আলোকে দেখা গেলে, শেখ হাসিনা–উত্তর বাংলাদেশের বন্যা–ঘূর্ণিঝড়–ভূমিকম্পকে সরাসরি “অমুক ব্যক্তির জন্য গজব” বলা বৈজ্ঞানিক বা শরঈ দৃষ্টিতে প্রমাণ–নির্ভর নয়; বরং এগুলোকে কোরআনের ভাষায় “বালা ও ইমতিহান”—আর আমাদের জন্য “ইবারত” বা আয়না হিসেবে দেখা বেশি ভারসাম্যপূর্ণ।
ফেরাউন–হাসিনা তুলনা
ফেরাউন–শেখ হাসিনার সরল তুলনা রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও কোরআনের বড় শিক্ষা সেখানে আটকে নেই। প্রকৃত শিক্ষা হলো—সুরা আর–রাদ ১৩:১১, সুরা আল–আ‘রাফ ৭:১৩০–১৩৩, সুরা হূদ ১১–এর আলোকে জুলুম–ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন থেকে তওবা–ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শনে ফিরতে পারছে কি না, সেটাই কোনো জাতির প্রকৃত মোড় পরিবর্তন। যদি শেখ হাসিনা–উত্তর বাংলাদেশও আগের মতোই দমন–পীড়ন, দুর্নীতি ও পরিবেশ–বিনাশের পথে চলে, তবে ফেরাউন–ফেরাউন বলা শুধু স্লোগান হয়ে থাকবে; দুর্যোগ তখনও আসবে, কিন্তু আমাদের জন্য কোনো বাস্তব পরিবর্তন বয়ে আনবে না। আর যদি এই কঠিন সময়কে সত্যিকারের তওবার দরজা বানানো যায়, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা রাজনৈতিক ঝড়—কোরআনের ভাষায় এগুলোই হবে “সতর্কতা ও রহমত”–এর আয়না, যেখানে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নিজের ভবিষ্যৎ নতুন করে লিখতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২২ বার পড়া হয়েছে