ঢাকার আকাশপথে আস্থাহীনতা: লাগেজ সুরক্ষায় ব্যর্থতার দায় এড়াচ্ছে কে?
বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:২১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ চুরি আর ব্যাগ কেটে মালামাল উধাও হয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আবারও প্রবাসী নিরাপত্তা ও বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।
সাম্প্রতিক একাধিক ভিডিও, যাত্রী অভিযোগ ও কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা মিলিয়ে ছবি পরিষ্কার হচ্ছে—ঘটনা শুধু ১৪ নভেম্বরের একটি ফ্লাইটে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কাঠামোগত দুর্বলতা ও জবাবদিহির অভাবের লক্ষণ।
একের পর এক লাগেজ কাটা ও চুরির অভিযোগ
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়—বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্টের পাশে কাটা ব্যাগ হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন প্রবাসীরা। কারও ব্যাগের নিচের অংশ ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে ভেতরের স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোন, নগদ টাকা ও গিফট আইটেম উধাও; আবার কোথাও তালা ভেঙে ভেতরের প্যাকেটগুলো তছনছ করা হয়েছে। প্রবাসীরা অভিযোগ করছেন, তারা বিদেশে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে পরিবারকে একটু ভালো কিছু দেওয়ার স্বপ্নে উপহার কিনেন, কিন্তু দেশে ফিরে সেই ব্যাগই হয়ে দাঁড়াচ্ছে দুঃস্বপ্নের প্রতীক।
প্রবাসীদের লক্ষ্য করে পরিকল্পিত চক্রের অভিযোগ
বেশিরভাগ অভিযোগ সৌদি আরবফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের লাগেজ ঘিরে, বিশেষ করে আউট-পাস বা ডিপোর্টি যাত্রীদের ক্ষেত্রে। তাদের মালামাল একত্রে বাল্ক কনসাইনমেন্ট হিসেবে পাঠানো হয়, ফলে প্রত্যেকের জিনিস আলাদা করে তালিকাভুক্ত থাকে না; এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র—এমন অভিযোগ উঠছে ভুক্তভোগী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক প্রতিবেদনে। একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাগ, একই জায়গা কেটে বা একই স্টাইলে তালা ভেঙে মালামাল নেওয়া হয়েছে, যা আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং “প্যাটার্ন”–এর ইঙ্গিত দেয়।
কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিভিল এভিয়েশন দাবি করছে, টার্মিনালের ভেতরে লাগেজ হ্যান্ডলিং এলাকা সিসিটিভির আওতায় থাকায় ঢাকায় চুরির সুযোগ কম; তারা অভিযোগের বড় অংশ ঠেলে দিচ্ছে উৎস দেশের (যেমন সৌদি আরবের) ইমিগ্রেশন ও হ্যান্ডলিং–এর ওপর। কিন্তু ভুক্তভোগীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন—যাত্রী তো ঢাকাতেই ব্যাগ হাতে পাচ্ছেন, ব্যাগ কাটা ও তালা ভাঙা অবস্থাও দেখছেন এখানে; তাহলে তদন্ত, দায় নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব কে নেবে? এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে জিডি বা অভিযোগের পরেও সুনির্দিষ্ট দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুবই কম।
নিরাপত্তা ব্যর্থতা নাকি প্রাতিষ্ঠানিক পচন?
বিমানবন্দর নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্টে বলা হচ্ছে, লাগেজ চুরি, ভিআইপি সুবিধা বাণিজ্য, কার্গো ভল্ট থেকে অস্ত্র/মূল্যবান দ্রব্য উধাও হওয়া—সব মিলিয়ে এটি একটি গভীরতর প্রাতিষ্ঠানিক পচনের লক্ষণ, যেখানে সাধারণ যাত্রী ও প্রবাসী শ্রমিকরা সবচেয়ে সহজ টার্গেট। নিরাপত্তা–সংস্থার উপস্থিতি, প্রযুক্তি ও বিভিন্ন স্তরের স্ক্যানিং থাকা সত্ত্বেও বারবার লাগেজ কাটা ও চুরির অভিযোগ ওঠা প্রমাণ করে, কোথাও না কোথাও অভ্যন্তরীণ যোগসাজশ বা ভয়াবহ গাফিলতি আছে।
প্রবাসী সুরক্ষায় কী জরুরি
বিশেষজ্ঞ ও যাত্রী–অধিকারকর্মীদের মতে, প্রবাসী শ্রমিকদের লাগেজ সুরক্ষায় কয়েকটি পদক্ষেপ এখনই জরুরি: আউট-পাস যাত্রীদের বাল্ক কনসাইনমেন্টের বদলে ব্যক্তিভিত্তিক ট্যাগিং ও ইনভেন্টরি, হ্যান্ডলিং–এর প্রতিটি ধাপে সিসিটিভি ফুটেজ রিটেইন বাধ্যতামূলক করা, অভিযোগ পেলে যৌথভাবে উৎস দেশ–গন্তব্য দেশের তদন্ত, এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের জন্য দ্রুত ক্ষতিপূরণের কার্যকর প্রক্রিয়া। না হলে, “এটা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা” বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি প্রবাসীদের আস্থাহীনতা আরও বাড়াবে এবং দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২১ বার পড়া হয়েছে