কবি আবদুল হাই মাশরেকীর গানে গণতন্ত্র ভাবনা
মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:৫৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলা লোকগীতির স্রোতে কবি আবদুল হাই মাশরেকী এক অমলিন এবং ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর, যিনি গ্রামের মাটি, শ্রমের ঘাম, আর মুক্তির স্বপ্নকে এক অনন্য সুরে বেঁধেছেন।
তাঁর কাব্য ও গানে গণতন্ত্র কেবল কোনো পুঁথিগত সংজ্ঞা বা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক মতবাদ নয়; এ হলো জীবন্ত, শ্বাসমান এক দর্শন যা লোকায়ত প্রজ্ঞা ও দার্শনিক গভীরতায় ভাস্বর। তাঁর গানে যে গণতন্ত্রের ধারণা মূর্ত হয়েছে, তা ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ-জ্যাক রুশোর সমষ্টিগত ইচ্ছা (General Will), ইতালীয় তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশির সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও প্রতি-আধিপত্য , এবং জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ইতিহাসচেতনা (Philosophy of History)-এর সঙ্গে অপ্রত্যাশিতভাবে মিলে যায়—অথচ তিনি এই সকল ধারণা প্রকাশ করেছেন সম্পূর্ণ লোকজ ভাষায়, তাঁর নিজস্ব উপমা এবং রূপকের বুননে। মাশরেকীর সৃষ্ট এই গণতান্ত্রিক আবহ বাংলা গানকে এক নতুন দার্শনিক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেখানে প্রান্তিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা মূলধারার রাজনৈতিক দর্শনের সমান্তরালে এক স্বতন্ত্র পথ তৈরি করেছে।
গণতন্ত্রের প্রথম ও সবচেয়ে জোরালো ঘোষণা তিনি করেছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সম্মিলিত সংগ্রামে। তাঁর "চারদিকে তোর নিকষ আঁধার" গানটি গণতান্ত্রিক জাগরণের এক প্রায় ম্যানিফেস্টো হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই গানে তিনি কোনো একক বীরত্বের অপারগতা ঘোষণা করেই পৌঁছে যান সেই অমোঘ আহ্বানে, যা সমষ্টির ক্ষমতাকে প্রশ্নাতীত করে তোলে: "শত হাতে শত মশাল জ্বাল-রে যাবে আঁধার ভয়াল, দিক দিগন্ত উজ্জ্বল হবে আসবে তবে আলোর জোয়ার।।"
এই "শত হাতে শত মশাল" রুশোর General Will-এর সরলতম লোকজ রূপ। রুশো যেমন মনে করতেন, জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা বা General Will-ই হলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের আসল উৎস, যা একক ব্যক্তির বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ইচ্ছার ঊর্ধ্বে; ঠিক তেমনি মাশরেকীর গানে এই "শত হাতে শত মশাল" কোনো একক ব্যক্তির মহিমা নয়, বরং সমষ্টির সম্মিলিত ইচ্ছাই এখানে ক্ষমতার একমাত্র উৎস এবং অন্ধকার দূরীকরণের একমাত্র উপায়। এখানে গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণার পরিবর্তে সম্মিলিত প্রয়াসের উপর, যা লোকায়ত জীবনে গ্রাম্য সালিশ বা পঞ্চায়েতের মতো সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। অন্ধকারকে তিনি কেবল রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্র বা রাজনৈতিক নিপীড়ন হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন এক গভীর সাংস্কৃতিক ভয়ের রাজত্ব হিসেবে – "স্কন্ধকাটা", "রক্ত-জিহ্বা", "ভূতের নাচন" – এই সকল উপমাগুলি গ্রামশির Cultural Hegemony-এর ধারণাটিকে মনে করিয়ে দেয়। গ্রামশি যেমন দেখিয়েছেন যে, শাসক শ্রেণি কেবল রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী শক্তির মাধ্যমেই নয়, বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এক বিশেষ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও ধারণাকে সাধারণ্যে প্রতিষ্ঠিত করে তাদের আধিপত্য বজায় রাখে; ঠিক তেমনি মাশরেকীও দেখিয়েছেন যে, গণতন্ত্রের পথে প্রধান অন্তরায় হলো এই সাংস্কৃতিক ভয়ের রাজত্ব, যা মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরাধীন করে রাখে। এই ভয়ের সংস্কৃতি ভাঙার একমাত্র অস্ত্র হলো জাগরণ এবং Counter-Hegemony বা প্রতি-আধিপত্যের সৃষ্টি। তাঁর ভাষায়: "জাগবে সকল সোনার ছেলে— ভাঙবে রে ঘুম ঘুমের পাড়ার।।"
এই "সোনার ছেলে"রা গ্রামের নিদ্রিত ও রাজনৈতিকভাবে অচেতন যুবক-সমাজ, যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ছাড়া গণতন্ত্র কেবল এক প্রহসন। তাদের জাগরণ কেবল ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত। এই জাগরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নতুন সংস্কৃতি, যেখানে ভয় নয়, বরং সাহস এবং সংহতিই মূল চালিকাশক্তি। মাশরেকী তাঁর গানে অত্যন্ত সহজ ভাষায় এই গভীর দার্শনিক সত্যকে উন্মোচন করেছেন যে, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো জনগণের মনস্তাত্ত্বিক মুক্তি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।
গণতন্ত্রের আরেক গভীর মাত্রা প্রকাশ পায় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের দাবিতে, যা প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা ও অবদানের স্বীকৃতিতে নিহিত। "বিজন খালে বিলে ফুটো" গানে শাপলা ফুলের রূপকল্পে মাশরেকী গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণির প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন, যাদের অবদান সমাজের গভীরে লুকায়িত হলেও তাদের শ্রমের ফসল সমাজের উপরিভাগে দৃশ্যমান হয়: "জলের উপর ফুল ফোটায় আর লুকায় রয় মূল। আপন মনে ফুটো রে ফুল আপন মনে হাসো জল-কাদার এই মাটি মায়ে নিরলে ভালবেসো।"
শাপলার মূল যেমন কাদায় লুকানো থাকে, কিন্তু তার সৌন্দর্যময় ফুল জলের উপর ভেসে ওঠে; ঠিক তেমনি সমাজের চালিকাশক্তি হয়েও অবহেলিত মেহনতি মানুষের শ্রম ও অবদান প্রায়শই অদৃশ্য থাকে। তাদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সভ্যতার সৌধ, কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন থাকে কাদা আর জলের গভীরে। এই নির্লোভ সরলতা এবং আত্মবিশ্বাসী স্ফুরণ অভিজাত শ্রেণির কৃত্রিমতা ও শোষণের বিপরীতে এক মানবতাবাদী ও সাধারণতান্ত্রিক আদর্শ স্থাপন করে। মাশরেকী এই ফুলের মধ্য দিয়ে সেই শ্রমজীবী মানুষের কথা বলেছেন, যারা নীরবে নিজেদের কাজ করে যান, কোনো প্রতিদানের আশা না করে মাটি মাকে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা কেবল প্রকৃতির প্রতি নয়, বরং নিজের শ্রমের প্রতি এবং সমাজের প্রতি তাদের নিবেদিত প্রাণের প্রতিচ্ছবি। এই রূপক গণতন্ত্রের সেই মূল আদর্শকে তুলে ধরে, যেখানে সমাজের প্রতিটি সদস্য, বিশেষত যারা প্রান্তিক এবং যাদের অবদান প্রায়শই উপেক্ষিত হয়, তাদের মূল্য ও মর্যাদা স্বীকার করা হয়। এটি গ্রামশির সাবল্টার্ন স্টাডিজ-এর ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে প্রান্তিক মানুষের নিজস্ব কণ্ঠস্বর এবং তাদের জীবনকে মূলধারার ইতিহাসের কেন্দ্রে আনার চেষ্টা করা হয়। মাশরেকী এই শাপলা ফুলের মাধ্যমে সমাজের সেই অদৃশ্য শক্তিকে দৃশ্যমান করে তোলেন, যাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। এই গানের গভীরে প্রোথিত আছে গণতন্ত্রের এক মৌলিক আকাঙ্ক্ষা – সাম্য ও মর্যাদা, যেখানে কেবল কতিপয় সুবিধাভোগী নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে।
গণতন্ত্রের জন্ম যে সহিংসতা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, বিশেষত যখন তা ঔপনিবেশিক বা স্বৈরাচারী শাসনের শিকল ভাঙার প্রশ্ন আসে, তা মাশরেকী দেখিয়েছেন রক্তের ভাষায়। তাঁর "পলাশ পলাশ রক্ত পলাশ" গানটিতে আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ফ্রানৎস ফ্যাননের সঙ্গে তাঁর সংলাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফ্যানন তাঁর "The Wretched of the Earth" গ্রন্থে উপনিবেশিত মানুষের মুক্তির জন্য সহিংসতার প্রয়োজনীয়তাকে যুক্তিযুক্ত করেছিলেন, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে উপনিবেশিক শাসন কর্তৃক আরোপিত সহিংসতাকে প্রতিরোধ করতে হলে পাল্টা সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে, যা নিপীড়িতের জন্য কেবল একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক মুক্তির প্রক্রিয়াও বটে। মাশরেকীর গানে এই ধারণা অনুরণিত হয়: "শিমুল গাছের ডালে ডালে থোকা থোকা রক্ত শিমুল। সে যে লাখো শহীদ হৃদয় রক্ত-রাঙা অর্ঘ্যেরই ফুল। রক্ত মাখা কাপড় দিয়ে রাঙা নিশান কে বানিয়ে..."
পলাশ ও শিমুলের লাল রং এখানে আর কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, এ হলো মুক্তির সহিংসতায় রাঙা শহীদের রক্ত। এই রক্তই নতুন জীবনের প্রতীক, নতুন দিনের সূর্যোদয়ের অঙ্গীকার। ফ্যাননের মতোই মাশরেকী বলছেন যে, শৃঙ্খল ভাঙতে এবং প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে রক্ত ঝরাতেই হয়। এই রক্তপাত কেবল আত্মত্যাগ নয়, এটি নিপীড়িতের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও বঞ্চনার বিস্ফোরক বহিঃপ্রকাশ, যা তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে মুক্ত করে এবং স্বীয় মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়। রক্তমাখা পতাকা বা "রক্ত-রাঙা নিশান" এখানে গণতন্ত্রের পবিত্রতম প্রতীক হয়ে ওঠে, যা শহীদের আত্মত্যাগের স্মারক বহন করে। মাশরেকী এই গানের মাধ্যমে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন যে, গণতন্ত্র কেবল একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া নয়, এটি ক্ষেত্রবিশেষে সহিংস বিপ্লবের ফসলও বটে, যেখানে নিপীড়িত জনতা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। এটি গণতন্ত্রের এক কঠিন, কিন্তু অনিবার্য বাস্তবতাকে তুলে ধরে, যা একদিকে বেদনার্ত হলেও অন্যদিকে মুক্তির অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত করে।
গণতন্ত্র কোনো এককালীন অর্জন নয়, এ এক অবিরাম প্রক্রিয়া, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। এই সত্য তিনি বলেছেন শহীদ-স্মৃতির মধ্যে দিয়ে, যেখানে মৃতরা নীরব সাক্ষী নন, বরং পথপ্রদর্শক। তাঁর "তারা আমাদের আত্মার আত্মীয়" গানে জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ইতিহাসচেতনা (Philosophy of History) লোকজ সুরে রূপান্তরিত হয়েছে। বেঞ্জামিন যেমন মনে করতেন যে, ইতিহাস কেবল ঘটনাপ্রবাহের সরলরৈখিক বর্ণনা নয়, বরং এটি অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এক জটিল ও গতিশীল সম্পর্ক, যেখানে অতীত বর্তমানকে আলোকিত করে এবং বর্তমান অতীতের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে; ঠিক তেমনি মাশরেকীও শহীদদেরকে কেবল অতীত ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখেননি, বরং বর্তমানের পথপ্রদর্শক এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে চিত্রিত করেছেন: "তাদের রক্তে রাঙা সূর্য ওঠে কুটিল আঁধার-অভিশাপ টুটে… তাদের প্রাণের আলোক-মশাল হাতে নিয়ে চলে জনতা বিশাল… পথে যেতে শোন গো পথিক তাদের সমাধি পাশেতে ক্ষণিক নীরবে দাঁড়ায়ে দুটি ফুল তুমি দিও।।"
শহীদরা মৃত নন, তারা নক্ষত্র হয়ে পথ দেখান। তাদের রক্তে রাঙা সূর্য কেবল নতুন দিনের প্রতীক নয়, এটি নতুন গণতন্ত্রের প্রতীক, যা অতীতের সকল অন্ধকার ও অভিশাপকে ছিন্ন করে। তাদের "প্রাণের আলোক-মশাল" প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জনগণের হাতে হাতে ঘুরে, যা গণতন্ত্রের পথকে আলোকিত রাখে। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া কেবল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন নয়, এটি নতুন প্রতিজ্ঞা এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার এক নীরব অঙ্গীকার। এই ফুল কেবল স্মৃতিচারণ নয়, এটি বর্তমানের দায়বদ্ধতা এবং ভবিষ্যতের প্রতি অঙ্গীকার। গণতন্ত্র এখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত এক জ্বলন্ত ধারা, যেখানে পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে এবং ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে। এই চেতনা বেঞ্জামিনের সেই ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর কাজকে অতীতের সেই মুহূর্তগুলোকে "একীভূত" করার সঙ্গে তুলনা করেন, যা বর্তমানের বিপ্লবাত্মক সম্ভাবনাকে জাগ্রত করতে পারে। মাশরেকী তাঁর গানে এই ঐতিহাসিক চেতনার একটি লোকায়ত ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, যেখানে শহীদদের স্মৃতি কেবল একটি শোকের বিষয় নয়, বরং এটি একটি সক্রিয় রাজনৈতিক ও নৈতিক শক্তি, যা গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে নিরন্তর গতিশীল রাখে। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যা প্রতি মুহূর্তে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত হয়।
গণতন্ত্রের আরেক জরুরি দিক হলো শোষক শ্রেণির সমাপ্তি টেনে নতুন দিনের সূচনা করা, যা কবির এই আহ্বানে ফুটে ওঠে:
"এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি
নতুন দিনের, নতুন দিনের, নতুন দিনের।
এসো করবো কায়েম
রাজ-
কলুষহীনের, কলুষহীনের, কলুষহীনের।
এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি...
গণ-মানুষের এই নব গণতন্ত্রে
নিষ্কলুষ করবো শাসনের যন্ত্রে
এসো খেলা শেষ করি-
শোষকের কপটের অর্বাচীনের।।
এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি...
এসো শেষের আঘাত হানি আর
দেরী নয়,দেরী নয়, দেরী নয়।
শোনো জনসাধারণ এই তো সময়-
এসো আজ বেছে নেই-
সজ্জন পরশী যে হৃদয়ের জমিন।।
এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি..."
এই গানটিতে কবি সরাসরি গণতন্ত্রের আহ্বান জানিয়েছেন, যা "কলুষহীনের" রাজত্ব কায়েম করার কথা বলে। "গণ-মানুষের এই নব গণতন্ত্রে / নিষ্কলুষ করবো শাসনের যন্ত্রে" – এই পংক্তিগুলো কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলে না, এটি শোষক শ্রেণির "কপটের অর্বাচীন" খেলা শেষ করার মাধ্যমে শাসনের যন্ত্রকে পরিশুদ্ধ করার কথা বলে। এখানে কবি একটি আদর্শবাদী রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে শাসন ক্ষমতা জনকল্যাণে নিয়োজিত হবে। গানের শেষে কবির "সজ্জন পরশী যে হৃদয়ের জমিন" বেছে নেওয়ার আহ্বানটি রাজনৈতিক ও নৈতিক শুদ্ধতার উপর জোর দেয়। এই গানটিতে অন্ধকার দূর করার, সাম্য প্রতিষ্ঠার এবং সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার ফলস্বরূপ একটি কলুষমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এটি গানটি যেনো তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং কর্মের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার এক বলিষ্ঠ অঙ্গীকার।
মাশরেকীর গানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গভীর দার্শনিক স্তর হলো ভয়মুক্তি। যে মানুষ নিজের মাটি ও শিকড়ের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত, সে আর কোনো শক্তিকে ভয় পায় না। এই ভয়মুক্তিই প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। তাঁর "বাংলা মা তোর শ্যামল বরণ" গানে তিনি এই গভীর সংযোগের কথা বলেছিলেন : "তোমার রূপে জুড়াই আঁখি, তোমার ধূলা অঙ্গে মাখি তোর বুকে চাই শেষের শরণ।।"
এই পংক্তিগুলিতে কবি মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি এক গভীর এবং আত্মিক বন্ধনের কথা বলছেন। "তোমার ধূলা অঙ্গে মাখি" – এই উক্তিটি কেবল মাটির প্রতি ভালোবাসা নয়, এটি মাটির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার, মাটির গভীরে প্রোথিত হওয়ার এক প্রতীকী প্রকাশ। যে মানুষ নিজের মাটির ধূলা অঙ্গে মাখে, নিজের শেকড়ের সঙ্গে এমন নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে, সে আর কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, স্বৈরাচারী শাসক, বা কোনো প্রকার ভীতি দেখানোর সামনে মাথা নত করে না। এই গভীর সংযোগ মানুষকে এক অপ্রতিরোধ্য মানসিক শক্তি এবং নৈতিক সাহস দান করে। এই ভয়মুক্তিই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি; কারণ নির্ভীক নাগরিকরাই কেবল স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে এবং নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে পারে। ভয়মুক্ত সমাজেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা সম্ভব। যখন একটি জাতি তার মাটি ও সংস্কৃতির প্রতি এমন অবিচল আত্মবিশ্বাস এবং ভালোবাসা পোষণ করে, তখন কোনো বাহ্যিক শক্তি বা অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারে না। মাশরেকীর এই দর্শন কেবল ব্যক্তিগত ভয়মুক্তির কথা বলে না, এটি একটি জাতির সম্মিলিত ভয়মুক্তির কথা বলে, যা গণতন্ত্রকে তার গভীরতম অর্থে সার্থক করে তোলে। এই নির্ভীকতাই জনগণকে একত্রিত করে এবং তাদের সমষ্টিগত ইচ্ছাকে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে, যা কোনো আঁধার বা ভয়াল পরিস্থিতিকে পরাভূত করতে সক্ষম। এটি রুশোর General Will-কে সক্রিয় করার জন্য একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত, যেখানে নাগরিকরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে সাধারণ কল্যাণের জন্য কাজ করে, কোনো ভয় বা চাপ ছাড়াই।
কবি আবদুল হাই মাশরেকীর গানে গণতন্ত্রের ধারণা বহুস্তরীয় এবং গভীর দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি কেবল লোকগীতির ধারায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তাঁর গানকে পরিণত করেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শনের এক শক্তিশালী মাধ্যমে। তাঁর গানে গণতন্ত্র কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এটি প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম, তাদের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা, আত্মত্যাগ এবং ভয়মুক্তির এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। রুশোর সমষ্টিগত ইচ্ছা থেকে শুরু করে গ্রামশির সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, ফ্যাননের মুক্তির সহিংসতা এবং বেঞ্জামিনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা—এই সকল দার্শনিক ধারণা মাশরেকীর লোকজ ভাষায় এক অভিনব জীবন লাভ করেছে। তাঁর "শত হাতে শত মশাল" দিয়ে অন্ধকার দূরীকরণের আহ্বান, শাপলা ফুলের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, এবং মাটির ধূলা অঙ্গে মেখে ভয়মুক্তির উপলব্ধি—এ সবই তাঁর গণতন্ত্র ভাবনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি দেখিয়েছেন যে, গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়, এটি একটি জীবনদর্শন, একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, এবং নিরন্তর সংগ্রামের ফল। তাঁর গান আজও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনে গণতান্ত্রিক চেতনার বীজ বপন করে চলেছে, যা আমাদের মুক্তির পথে অবিরাম প্রেরণা জোগায়। আবদুল হাই মাশরেকী প্রমাণ করেছেন যে, লোকসাহিত্য কেবল মনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, এটি গভীরতম দার্শনিক সত্য প্রকাশেরও এক শক্তিশালী আশ্রয়স্থল, যা সমাজের তৃণমূল থেকে গণতন্ত্রের সুমধুর সুর ছড়িয়ে দিতে পারে। তাঁর গানগুলো তাই কেবল ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং আগামী দিনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্যও এক আলোকবর্তিকা।
১১৭ বার পড়া হয়েছে