সর্বশেষ

জাতীয়ঢাকায় আবারও ৩.৬ মাত্রার ভূমিকম্প, উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল
প্লট দুর্নীতি মামলায় শেখ হাসিনার ২১ বছর, জয়ের ৫ বছর এবং পুতুলের ৫ বছর কারাদণ্ড
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ৭ জনের মৃত্যু, নতুন ভর্তি ৫৬৭
সৌদি আরবসহ সাত দেশে প্রবাসীদের ভোট নিবন্ধন সাময়িক স্থগিত
দুদকের সব কর্মকর্তার সম্পদের বিবরণ বাধ্যতামূলক: প্রেস সচিব
দেশজুড়ে ১৩৬ পুলিশ পরিদর্শকের বদলি
হাসপাতালের সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া
সারাদেশঝিনাইদহে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে ১০ জন আহত, বাড়িঘর ভাংচুর
আন্তর্জাতিকহংকংয়ে আবাসিক কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৫
পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজকারার ১৪ বছরের কারাদণ্ড
চীনে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ রেলশ্রমিকের মৃত্যু
মিয়ানমারে ৩ হাজার রাজবন্দি মুক্তি, ৫৫০০ জনের অভিযোগ প্রত্যাহার
হোয়াইট হাউসের কাছে ন্যাশনাল গার্ডের দুই সদস্যকে গুলি
খেলাবিপিএল শুরু ১৯ ডিসেম্বর, ফাইনাল ১৬ জানুয়ারি
এমবাপ্পের চার গোলেও রিয়ালের কষ্টার্জিত জয় গ্রিসে
সাহিত্য

কবিতায় নান্দনিকতা

গাউসুর রহমান 
গাউসুর রহমান 

রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ ৩:২৯ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
কবিতা, মানব ইতিহাসের এক সুপ্রাচীন শিল্পরূপ, কেবল ভাব বিনিময়ের মাধ্যম নয়, বরং অভিজ্ঞতার গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত এক সুনির্মিত আলঙ্কারিক প্রতিভাস। এই শিল্পরূপের মূল ভিত্তিভূমি হলো নান্দনিকতা—যা সৌন্দর্য, শিল্পিত রুচি এবং আনন্দ-সৃষ্টির তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে।

নান্দনিকতা (Aesthetics) শব্দটি গ্রিক ‘Aisthesis’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতি বা উপলব্ধি। কবিতার ক্ষেত্রে, এই উপলব্ধি কেবল বাহ্যিক রূপগত মাধুর্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা প্রবেশ করে কবি-সৃজনের অন্তর্নিহিত সত্য ও পাঠকের মানসিক আস্বাদনের জটিল প্রক্রিয়ায়। কবিতা ও নান্দনিকতা তাই দুটি সহোদর ধারণা; কবিতা তার অস্তিত্বের জন্য নান্দনিক মানদণ্ডের উপর নির্ভরশীল, এবং নান্দনিকতা কবিতার মাধ্যমেই তার চরম সার্থকতা খুঁজে পায়।

 

কবিতার নান্দনিক বিচার মূলত তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত—রূপগত সৌন্দর্য, অর্থগত গভীরতা, এবং রসগত অনুভব। রূপগত সৌন্দর্য অর্জিত হয় ছন্দ, অলংকার এবং শব্দবিন্যাসের মাধ্যমে, যা কবিতার বহির্কাঠামোকে চিত্তাকর্ষক করে তোলে। অর্থগত গভীরতা নির্ভর করে ধারণার মৌলিকতা, চিত্রকল্পের অভিনবত্ব এবং বক্তব্যের দূরবিস্তৃত তাৎপর্যের উপর। কিন্তু কবিতার নান্দনিকতার চরম শিখর হলো রসগত অনুভব—অর্থাৎ, পাঠক বা শ্রোতার মনে সৃষ্ট সেই অনির্বচনীয় আনন্দ, যা স্থূল আবেগ থেকে মুক্ত হয়ে এক বিশুদ্ধ, সাধারণীকৃত উপলব্ধির জন্ম দেয়। প্রাচীন কাব্যতত্ত্বের মূল লক্ষ্য ছিল এই রস-সৃষ্টির পথ উন্মোচন করা। কাব্যতত্ত্ববিদগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিল্পীর নিপুণ সৃষ্টি কেবল আবেগ সঞ্চার করে না, বরং সেই আবেগকে এমনভাবে পরিশোধিত করে যে তা পাঠকের নিজস্ব সুখ-দুঃখের গণ্ডি পেরিয়ে এক সর্বজনীন আনন্দের স্তরে উন্নীত হয়। এই প্রক্রিয়ায়, বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী ভাবের সংযোগে স্থায়িভাবের রসে পরিণত হওয়ার ধারণাটি কবিতার নান্দনিক ভিত্তি হিসেবে চিরন্তন হয়ে আছে। কাব্যপাঠকালে পাঠক যে বিস্ময়, চমৎকৃতি বা অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করেন, তার মূলে রয়েছে কবির বিশেষ বাচনভঙ্গি, যাকে ধ্বনিবাদীরা ‘ধ্বন্যাত্মক কাব্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আচার্য আনন্দবর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোক গ্রন্থে স্পষ্ট করেছেন যে, কাব্য কেবল শব্দের মাধ্যমে বাচ্যার্থ বহন করে না, বরং বাচ্যার্থের আড়ালে এক ব্যঙ্গ্যার্থ বা ধ্বনিকে প্রক্ষেপ করে, যা কাব্যের আত্মা এবং নান্দনিকতার মূল উৎস। যে কবিতা কেবল তথ্য বা বক্তব্য প্রকাশ করে, তা কাব্য পদবাচ্য হলেও নান্দনিকতার উচ্চ শিখর স্পর্শ করতে পারে না; নান্দনিকতার পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটে সেখানেই, যেখানে শব্দ তার অভিধা শক্তিকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনার মাধ্যমে অতিরিক্ত দ্যোতনা সৃষ্টি করে।

 

 

শব্দ হলো কবিতার বুনিয়াদি উপাদান, আর সেই শব্দের নান্দনিক ব্যবহারই কবিতাকে অন্য সকল গদ্যরূপ থেকে স্বতন্ত্র করে। কবির শব্দচয়ন তাই কেবল অর্থবহতার নিরিখে নয়, ধ্বনিগত মাধুর্য, চিত্রকল্প সৃষ্টির ক্ষমতা এবং ভাবের প্রতীকায়নের নিরিখেও বিচার্য। এক একটি নির্বাচিত শব্দ যেন এক একটি স্ফটিক, যা সঠিক স্থানে স্থাপন করলে সমগ্র কবিতার আলোকসজ্জা পরিবর্তিত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো কবি প্রচলিত অথবা লৌকিক শব্দকে অপ্রত্যাশিতভাবে, নতুন ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করেন, তবে সেই ব্যবহারে এক নতুন নান্দনিক চমক সৃষ্টি হয়। এই চমক শুধু পাঠকের বুদ্ধিকে আঘাত করে না, বরং তার অনুভূতিকেও গভীরতর স্তরে আলোড়িত করে। শব্দের এই কারিগরিকে রীতিবাদীরা (Riti School) অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে বিশেষ কাব্য-রীতির (Vaidarbhi, Gaudi, Panchali) মাধ্যমে কাব্যসৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করা হতো। যদিও পরবর্তীতে রস ও ধ্বনিবাদীরা রীতির চেয়ে ভাবের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তবুও শব্দের সুবিন্যস্ততা যে নান্দনিকতার অপরিহার্য শর্ত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

 

ছন্দ হলো কবিতার নান্দনিক কাঠামোর মেরুদণ্ড। ছন্দ কেবল গতির নিয়ন্ত্রক নয়, এটি ভাবের বাহকও বটে। একটি কবিতার বিষয়বস্তু এবং তার ভাবানুষঙ্গের সঙ্গে ছন্দের একটি গভীর সম্পর্ক থাকে। যেমন, বীরত্ব বা ওজস্বী ভাবের জন্য দ্রুত লয়ের ছন্দ এবং বিষাদ বা শান্ত ভাবের জন্য ধীর, মন্থর গতি প্রায়শই ব্যবহৃত হয়। এই ছন্দ পাঠকের শারীরিক ও মানসিক লয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে একধরনের সম্মোহন সৃষ্টি করে। যখন ছন্দ এবং অর্থ একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে, তখন কাব্যিক অভিজ্ঞতা একটি পূর্ণাঙ্গ নান্দনিক রূপ লাভ করে। এই কারণেই, আধুনিক যুগে কবিরা যখন প্রচলিত ছন্দকে ভেঙেছেন, তখনও তাঁরা ছন্দের মূল লয় বা গতির ধারণাটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেননি, বরং তাঁরা নতুন ধরনের গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দ তৈরি করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ভাবের মুক্তিকে নতুন নান্দনিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা। এই নতুন কাঠামো, আপাতদৃষ্টিতে আলংকারিক না হলেও, একটি অভ্যন্তরীণ লয় বা স্পন্দন বজায় রাখে, যা পাঠককে এক বিশেষ মানসিক প্রক্রিয়ায় চালিত করে।

 

নান্দনিকতার ক্ষেত্রে অলংকারের ভূমিকা বিতর্কের জন্ম দিলেও, এটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অলংকার—উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, অতিশয়োক্তি—কেবল প্রসাধনী নয়, বরং ভাবকে মূর্ত করে তোলার অপরিহার্য কৌশল। যখন একজন কবি বলেন, "আমার হৃদয় মরুভূমি," তখন এই উপমা কেবল একটি সাদৃশ্যমূলক বিবৃতি নয়, এটি হৃদয়ের শুষ্কতা ও শূন্যতার অনুভূতিকে পাঠকের কাছে আরও তীব্রভাবে সঞ্চারিত করে। অলংকার যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবের অনুগামী হয়, যখন তা কৃত্রিমভাবে চাপানো না হয়, তখনই তা নান্দনিক মূল্য লাভ করে। যে আলংকারিক প্রয়োগ কাব্যের মূল রসকে ক্ষুণ্ণ না করে তাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে, সেটিই সার্থক নান্দনিক উপাদান। অলংকারবাদীরা যদিও অলংকারকেই কাব্যের সর্বস্ব মনে করতেন, উত্তরকালের চিন্তাধারা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে অলংকার হলো সেই আলো, যা ধ্বনি বা রসের মূল সত্যকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে।
কবিতার নান্দনিকতা শুধুমাত্র সৃষ্টিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর পূর্ণতা নির্ভর করে গ্রহীতার উপলব্ধির উপর। এই প্রক্রিয়াটিকে কাব্যতত্ত্বীরা ‘সাধারণীকরণ’ নামে অভিহিত করেছেন। কবি যখন নিজস্ব ব্যক্তিগত আবেগ বা অভিজ্ঞতাকে এমন ভাষায় প্রকাশ করেন, যা পাঠকের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক সার্বজনীন মানবিক সত্যে পরিণত হয়, তখনই সাধারণীকরণ ঘটে। এর ফলে, পাঠক সেই আবেগকে নিজের বলে মনে করলেও, তা থেকে একধরনের দূরত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন, যা তাঁকে বিশুদ্ধ নান্দনিক আনন্দ দেয়। এই দূরত্বই হলো শিল্প উপভোগের শর্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সাহিত্য’ প্রবন্ধে এই সাধারণীকরণের ধারণাকেই শিল্পের মুক্তি হিসেবে দেখেছেন। কবিতার সৌন্দর্য তাই কবির ব্যক্তিগত যন্ত্রণা বা আনন্দ নয়, বরং সেই অভিজ্ঞতার শিল্পিত রূপান্তর যা পাঠককে এক আবেগ-মুক্ত অথচ গভীরতম অনুভূতির জগতে নিয়ে যায়।

 

আধুনিক কবিতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে নান্দনিকতার ধারণা এক বিশাল বাঁক নিয়েছে। রোমান্টিক যুগে সৌন্দর্য ছিল মূলত শুভ, মঙ্গল ও মহৎ-এর প্রতি নিবেদিত। প্রকৃতি, প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতা ছিল নান্দনিকতার প্রধান উৎস। কিন্তু যখন আধুনিকতা (Modernism) এলো, তখন সৌন্দর্য কেবল গোলাপের বা চাঁদ-তারার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। নাগরিক জীবনের জটিলতা, ক্লান্তি, নৈরাশ্য, এমনকি বীভৎসতাও শিল্প ও কাব্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। আধুনিক কবিরা ‘কুৎসিত’ (Ugly) বা ‘অশুভ’কেও (Evil) নান্দনিকতার পরিসরে টেনে এনেছেন। এই ‘বিপরীত নান্দনিকতা’ (Counter-Aesthetics) হলো আধুনিক কালের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ফরাসি কবি বোদলেয়ার (Baudelaire) যেমন ‘ফ্ল্যর দু মাল’ বা ‘মন্দের ফুল’ রচনা করে দেখিয়েছেন যে, পঙ্কিলতা, বিকার, বা জীবনের গ্লানিও সুনিপুণ শিল্পকলার মাধ্যমে এক প্রকার তীব্র, মর্মান্তিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। এই সৌন্দর্য হয়তো চিরায়ত শান্ত রসাশ্রিত আনন্দ দেয় না, কিন্তু এটি পাঠকের মনকে এক গভীর এবং জটিল সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এক নতুন ধরনের ‘বিস্ময়’ বা চমত্কার সৃষ্টি করে। এই বিস্ময় বা চমত্কারই হলো আধুনিক কবিতার নান্দনিক উপাদান।

 

আধুনিক নান্দনিকতা জোর দেয় রূপক, প্রতীকের ব্যবহার এবং মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা প্রকাশের উপর। এই যুগে, কবিতার ভাষা আরও ঘন, বহুস্তরীয় এবং ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে। কবিদের উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি আবেগ প্রকাশ না করে, চিত্রকল্পের মাধ্যমে সেই আবেগ বা ভাবকে প্রক্ষেপ করা। উদাহরণস্বরূপ, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যখন “ধূসর পাণ্ডুলিপি” বা “তিমির হননের শিশির” আসে, তখন এই চিত্রকল্পগুলি কেবল দৃশ্য বর্ণনা করে না, বরং এক গভীর বিষাদ, ইতিহাস-চেতনা এবং একাকীত্বের মনস্তাত্ত্বিক আবহ সৃষ্টি করে, যা পাঠকের কাছে এক নতুন নান্দনিক সংবেদন এনে দেয়। এই নান্দনিকতা কেবল শ্রুতিমধুরতা বা সরল বিন্যাসের মধ্যে আনন্দ খোঁজে না, বরং তা জটিলতা, স্ববিরোধিতা এবং বৌদ্ধিক অনুসন্ধানের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেয়। এটি হলো এমন এক নান্দনিকতা যা পাঠককে নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা না রেখে সক্রিয় অংশগ্রহণে বাধ্য করে।

 

কবিতার নান্দনিকতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হলেও, এর মূল ভিত্তি অপরিবর্তিত থাকে: তা হলো, নিছক বাস্তবতাকে অতিক্রম করে এক কল্পিত, শিল্পিত বাস্তবতার সৃষ্টি করা, যা পাঠককে এক বিশেষ ধরনের মানসিক অভিজ্ঞতা প্রদান করে। এই অভিজ্ঞতাটিই হলো কাব্যিক আনন্দ। যখন কোনো কবিতা কেবল ভাষা ও ছন্দের খেলায় আটকে থাকে, কিন্তু তাতে কোনো গভীর রস বা ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা তৈরি হয় না, তখন সেই কবিতা নান্দনিক বিচারে দুর্বল বলে গণ্য হয়। আবার, যে কবিতা কেবল বক্তব্য বা নীতিশিক্ষা দেয়, কিন্তু শিল্পিত রূপ ও শৈলীর অভাব থাকে, সেটিও কাব্যের পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা লাভ করতে পারে না। অতএব, সার্থক কবিতার নান্দনিকতা হলো রূপ (Form) এবং ভাব (Content)-এর এক অভূতপূর্ব মিলনস্থল।

 

নান্দনিক বিচারকের কাছে কবির দায়বদ্ধতা হলো শিল্পের প্রতি, সত্যের প্রতি নয়। যদিও কবি সত্যের অনুসন্ধান করেন, কিন্তু সেই সত্যকে তিনি সরাসরি প্রকাশ করেন না, বরং তাকে শিল্পের আবরণে মণ্ডিত করেন। এই আবরণের মধ্যেই নান্দনিকতা লুকায়িত। যখন কবি অপ্রচলিত উপমা ব্যবহার করে প্রথাগত দৃষ্টিকে চ্যালেঞ্জ জানান, যখন তিনি ভাষাকে তার স্বাভাবিক ব্যবহার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন অর্থে স্থাপন করেন, তখন এই ‘বিচ্যুতি’ (Deviation) নিজেই নান্দনিক ক্রিয়ার জন্ম দেয়। এই বিচ্যুতি প্রমাণ করে যে শিল্পীর হাতে ভাষা কেবল যোগাযোগের হাতিয়ার নয়, এটি সৃষ্টি ও রূপান্তরের এক রহস্যময় মাধ্যম।

 

কবিতার নান্দনিকতা কোনো একটি নির্দিষ্ট উপাদান বা সংজ্ঞা দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। এটি একটি বহুস্তরীয়, গতিশীল ধারণা, যা যুগ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। ক্লাসিক্যাল কাব্যতত্ত্ব যেখানে রস, ধ্বনি এবং অলংকারকে প্রাধান্য দিয়েছিল, সেখানে আধুনিক কাব্যতত্ত্ব জোর দিয়েছে চিত্রময়তা, প্রতীকায়িতা, মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা এবং বিরুদ্ধ নান্দনিকতার উপর। কিন্তু এই সকল ধারার মূল সুরটি হলো, শব্দ ও ছন্দের ব্যবহারে এমন এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করা, যা পাঠককে ক্ষণিকের জন্য জীবনের দৈনন্দিন গ্লানি থেকে মুক্ত করে এক বিশুদ্ধ আনন্দের জগতে নিয়ে যায়। একজন কবি যখন তাঁর অনুভূতিকে শব্দে গেঁথে তোলেন, তখন তিনি কেবল লেখেন না, তিনি এক জগৎ নির্মাণ করেন, আর সেই জগতের প্রবেশদ্বার হলো নান্দনিকতার সেতু। কবিতার অস্তিত্ব এই নান্দনিকতার উপরেই নির্ভরশীল, এবং যতদিন মানব সমাজে সৌন্দর্য-বোধের প্রতি আগ্রহ থাকবে, ততদিন কবিতার এই শিল্পরূপ তার মহিমা নিয়ে বিরাজ করবে। কবিতায় নান্দনিকতা তাই কেবল একটি তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, এটি জীবন ও শিল্পের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কসূত্র।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সহকারী অধ্যাপক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।

১৭৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন














সর্বশেষ সব খবর
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন