সর্বশেষ

মতামত

শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সাক্ষাৎকার: অস্বীকার, বিতর্ক ও গণবিচার

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫ ৩:০৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত শেখ হাসিনার একাধিক ‘ইমেইল সাক্ষাৎকার’ বাংলাদেশি সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন আলোড়ন তুলেছে।

এই সাক্ষাৎকারগুলোতে গুম, দমন-পীড়ন, গণতান্ত্রিক অধিকারের দমন, অর্থ পাচার, নির্বাচনী কারচুপি, ব্যাংক লুট, সহিংস রাষ্ট্রীয় অভিযান, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচার–সব বিষয় নিয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয় শেখ হাসিনাকে। কিন্তু প্রতিবার দৃঢ়ভাবে অস্বীকারের গাঁথুনি আর আত্মউপস্থিতির আভিজাত্যে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন; দিয়েছেন এককেন্দ্রিক বিবৃতি।

গুম, নিপীড়ন ও মানবাধিকার
শুরুতেই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। গত ১৬ বছরজুড়ে হাজারো মানুষ নিখোঁজ–এই অভিযোগ আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রীয় তদন্ত রিপোর্টে স্বীকৃত। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, “এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারিত গল্প, কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত বা নির্দেশে নয়।” কিন্তু প্রামাণ্য দাবির অভাবে এবং আইনি ব্যবস্থার অন্ধকারে এসব মানুষ আজও পরিবার-বিচ্ছিন্ন।

রাজনৈতিক অধিকারের দমন ও কারাবন্দি রাজনীতি
গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করার সকলের অধিকার—এই মৌলিক অধিকারের বিড়ম্বনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মদের জন্য পাঠ্যবইয়ের গোঁজামিল। বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ, কর্মী ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের দমন-পীড়ন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, রিমান্ড-নিপীড়ন; এমনকি বহুল আলোচিত ‘জঙ্গি নাটক’ সাজিয়ে অভিযানে হত্যার প্রশ্ন ছিল এই সাক্ষাৎকারে। উত্তর দেন, “জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তিপূণ পরিবেশ বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছি। শেখ হাসিনা বারবার এই প্রশ্নগুলোকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে আখ্যা দেন।

অর্থ পাচার, ব্যাংক-লুট ও অলি-গার্কদের পদক্ষেপ
অতীত দুই দশকে বাংলাদেশ থেকে নিষিদ্ধ ও বেআইনি পথে অর্থ বিদেশে পাচার, ব্যাংক ও আর্থিক বাজারের ঘাঁটি দখল, ক্ষমতাবানদের সম্পদ বৃদ্ধির বিস্ময়কর তথ্য ঘুরে ফিরে আসে বিশ্ব ব্যাংক, গার্ডিয়ানের মতো রিপোর্টে। এই সব প্রশ্নও একাধিকবার ওঠে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে। হাসিনার সংক্ষিপ্ত উত্তর— “সব রাজনৈতিক অপপ্রচার, কোনো তথ্যপ্রমাণে প্রতিষ্ঠিত নয়; আমার সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে।” অথচ বাস্তবতায়, ব্যাংক-ঋণ কেলেঙ্কারিতে দায়ী ব্যক্তিরা অধিকাংশই ছিলেন সরকারি ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ বলে বিদেশি রিপোর্টে আছে।

বিদেশে সম্পদ ও মন্ত্রীদের বিত্ত
শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী, রাজনীতিক ও উপদেষ্টাদের বিদেশে বিপুল সম্পত্তি–এ খবরে আন্তর্জাতিক মিডিয়া মুখর। সাক্ষাৎকারে বারবার খোঁচা দেওয়া এই প্রশ্নে হাসিনা বলেন, “এসব রাজনৈতিক কারণে বানানো গল্প, কোনো প্রমাণ নেই। কারও বিরুদ্ধে কিছু থাকলে তদন্ত হচ্ছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে”—এই নিরপেক্ষত্বের ছদ্মবেশ জারি রাখেন।

পরপর তিন নির্বাচনে কারচুপি, ভোট ডাকাতি ও ক্ষমতাগ্রহণ
২০১৪, ২০১৮, ২০২৪—তিন জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপি, প্রশাসনিক সহায়তায় নির্বাচনি ফল ছিনিয়ে নেওয়া, বৈশ্বিক পর্যবেক্ষকদের সমালোচনা এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণ প্রসঙ্গটি সাক্ষাৎকারজুড়ে বহুবার স্থান পায়। হাসিনা এগুলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে বলেন, “আমার অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, বিএনপি নিজেরাই পরে বয়কট করেছে। নির্বাচনি কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন।” কিন্তু ফলাফলে জনগণেরও, বিশেষজ্ঞদেরও আস্থা নেই–এবং দেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন একতরফা বন্দিত্বে পিষ্ট।

আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল: বিচার না রাজনৈতিক প্রতিহিংসা?
অন্যায় বিচার, মিথ্যা সাক্ষ্য, নিরাপরাধদের সাজানো মামলায় ফাঁসি—এই প্রশ্নও তাঁর কাছে জরুরি। শেখ হাসিনা বলেছেন, “ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানে নিরীক্ষিত, কোনো নিরপরাধকে সাজা হয়নি।” বাস্তবে মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়া, প্রমাণ গুম, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ–এসবকিছুই উহ্য থাকল তাঁর ভাষণে।

স্বীকারোক্তি, অনুশোচনা ও আত্ম অহমিকা
দীর্ঘ ১৬ বছরে দমন-নিপীড়ন, গুম, হত্যা, অর্থ পাচার, বিচারহীনতা—সবকিছুর দায় শেখ হাসিনার ওপর বর্তিয়েছে জাতির সামনে। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলো হয়ে উঠেছে আপোষহীন আত্মবিচারের মঞ্চ, যেখানে অপরাধের বদলে তাঁর কণ্ঠে শোনা যায় ‘শাসকোচিত’ আত্মবিশ্বাস; স্বীকারোক্তির বদলে বারবার অস্বীকার, দোষারোপ, রাজনৈতিক প্রচারণা আর আইনি দায় এড়িয়ে সর্বশেষে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা।

সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় মিডিয়া মুখর হলেও, বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সাক্ষাৎকারগুলোর নিরপেক্ষতা—প্রতিপক্ষ বলছে, মুখপাত্রদের লিখে দেওয়া উত্তর, লাখো ডলারের পিআর এজেন্সির ঘুণপোকা ও কানাডিয়ান-ব্রিটিশ আইনজীবীদের তৈরিকৃত গ্ল্যামার-পর্দা ঢাকা বিবৃতি। পশ্চিমা সাংবাদিকরাও সংশয়মুক্ত নন—সাক্ষাৎকার আসলেই কতখানি সত্য আর কতখানি সাজানো, সেটা নিয়েই বিতর্ক চলে।

শেষ কথা: বিচারের সামনে আস্ফালন
অবশেষে প্রশ্ন থাকে—একজন আদলে প্রশাসক, কার্যত শাসক, বহু রক্ত আর কান্নার গল্প রেখে যাওয়া নেত্রী কীভাবে বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন? আগামীকাল ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় মুখোমুখি হবেন হাসিনা ও তাঁর সহচররা। তিনি আজ যেভাবে অস্বীকার আর আত্ম-দম্ভে সংবাদমাধ্যমকে ভুলাচ্ছেন, বিচার রায়ে তারই প্রকাশ ঘটবে—একি শেষ হাসির আগে চরম আস্ফালন?


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। 

১৪৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন