শিক্ষা ও গবেষণায় সংকট: বিনিয়োগ ও সংস্কার জরুরি
বৃহস্পতিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:৫২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা খাত আজ এক গভীর সংকট ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাখাতে আমরা অবকাঠামোগত প্রসার দেখেছি, কিন্তু গুণগত মান ও গবেষণার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় এখনও পিছিয়ে রয়েছি।
জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৫৩%—এটি ইউনেস্কোর সুপারিশকৃত ৬% এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত (জিডিপির ৪%-এর বেশি) ও ভুটানের (প্রায় ৫.৮৫%) তুলনায় নগণ্য। বরাদ্দের এই স্বল্পতা শিক্ষার মান ও গবেষণার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সংস্কৃতি এখনও দুর্বল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বছরে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করে না। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ, আধুনিক গবেষণাগার ও লাইব্রেরির অভাব এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির দুর্বলতা আমাদের উচ্চশিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মান থেকে দূরে রাখছে। শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞানও দিন দিন দুর্বল হচ্ছে—গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষায় দৃঢ় ভিত্তির অভাব লক্ষণীয়। এর মূল কারণ প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব এবং পাঠ্যক্রমের গতানুগতিক ধারা।
নীতিগত চ্যালেঞ্জও কম নয়। জ্ঞানচর্চার স্বাধীন পরিবেশের অভাব এবং কেন্দ্রীয়কৃত ব্যবস্থা স্থানীয় উদ্ভাবনকে ধ্বংস করছে। ফলস্বরূপ, বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে (২০২৫) ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম এবং বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম। উচ্চশিক্ষা উপখাতে আমাদের অবস্থান আরও শোচনীয়—১২৯তম।
তবে আশার কথা, সম্ভাবনার দিকও কম নয়। দেশে এখন ১৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। যেমন—ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ১১০টি গবেষণা প্রকল্পে ৪৭টি দেশি ও ৫১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করেছে। এছাড়া এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর মতো প্রতিষ্ঠানও গবেষণা ও শিক্ষার প্রসারে কাজ করছে। ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও গবেষণা বাজেট বৃদ্ধির দাবি ছাত্রসমাজের জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেয়।
এ সংকট থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। শিক্ষা ও গবেষণা বাজেট ধাপে ধাপে জিডিপির ৬%-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। বরাদ্দের স্বচ্ছ ব্যবহার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেন্দ্রীয় এক্সেলেন্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণার অর্থায়ন ও ব্যবহারিক সমাধানে শিল্প ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। ইন্টার্নশিপ ও শিল্প-অনুপ্রাণিত প্রকল্প বাধ্যতামূলক করতে হবে। মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা, সৃজনশীলতা ও ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে।
যার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণা খাত এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পরিমাণগত সম্প্রসারণকে গুণগত উৎকর্ষে রূপান্তর করতে না পারলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেব। সময় এসেছে বিনিয়োগ, সংস্কার এবং গবেষণা সংস্কৃতির প্রসারে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার। এটিই কেবল দেশের টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভিত্তি রচনা করবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
১৫৮ বার পড়া হয়েছে