শিক্ষার লক্ষ্য চাকুরি না চরিত্র গঠন?
বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১০:০৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
শিক্ষার অন্যতম একটি স্লোগান “জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে পড়”। ‘সেবা’ শিক্ষার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। সেবার মানসিকতা তৈরি হয় ভালো চরিত্র থেকে, আর ভালো চরিত্র তৈরি হয় ভালো শিক্ষা থেকে, আর ভালো শিক্ষা আসে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে।
বর্তমান সময়ে শিক্ষা হয়েছে একটি কর্পোরেট প্রতিযোগিতার অন্যতম মাধ্যম। শিক্ষার্থীরা দ্রুত চাকুরি পাওয়ার আশায় একাডেমিক পাঠকে সমাপ্ত করার আগেই গতানুগতিক চাকুরির জন্য পড়াশুনাতে লিপ্ত হয়েছে এবং তারা বিভিন্ন পেশায় নিজেদেরকে যুক্ত করেছে। যার ফলে, চরিত্র গঠনের দিকটা তাদের চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার গতানুগতিক ডিগ্রি নিয়ে ব্যক্তি ভালো ক্যারিয়ার পজিশনে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে সে খারাপ কাজের সাথে যুক্ত, দুর্নীতির মতো সামাজিক ক্যান্সারের সাথে যুক্ত। তাহলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী? এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার জন্য শিক্ষা, চাকুরি এবং চরিত্র নিয়ে জানা উচিত। শিক্ষা, চাকুরি এবং চরিত্র নিয়ে প্রতিনিয়তই একধরনের অসামঞ্জস্য আলাপ দেখা যাচ্ছে যত্রতত্র।
শিক্ষা মানুষের জীবনপ্রবাহের অন্যতম একটি মাধ্যম। সেটি হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক অথবা পারিবারিক বা সামাজিক। কোনো শিক্ষা কখনোই মানুষকে খারাপ পথে ধাবিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে না। অপরদিকে চাকুরি এমন একটি বিষয় যার উপর থাকে মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা, জীবনধারণের উপায়। আমরা সহজ ভাষায় যাকে ক্যারিয়ার বলি। বস্তুগত চাহিদা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চাকুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থেকেও মানুষ চাকুরি করতে পারে। দাপ্তরিক ভালো কোনো অবস্থানের চাকুরির জন্য অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। বস্তুগত চাহিদার অতিরিক্ত পূরণ করার মানসিকতা থেকেই তৈরি হয় অসদুপায়ের বাসনা, আর তখনই মানুষকে তাড়িত করে চরিত্রহীন হতে, খারাপ কাজে নিজেকে যুক্ত করতে।
চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ আসে শিক্ষার মাধ্যম থেকে। এটি এমন একটি মূল্যবোধ যা মানুষ প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজ থেকে গ্রহণ করে। ব্যক্তির কর্ম, সামাজিক মেলামেশা, সুচিন্তা, আচার-ব্যবহার, চলাফেরা ও কথাবার্তা—সবই চরিত্রকে চিহ্নিত করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বা ছাড়া একজন মানুষ চাকুরি পেতে পারে, কিন্তু তার ভেতর ভালো চরিত্রের মূল্যবোধ না থাকলে সমাজ তার শিক্ষার কোনো ফল ভোগ করতে পারে না, মানুষ তার শিক্ষার মাধ্যমে উপকার পায় না। যদি সমাজ, মানুষ এবং রাষ্ট্র কোনো উপকারই না পেল, তাহলে সে শিক্ষার ফল কী? এখানেই প্রশ্ন আসে চরিত্রের।
চরিত্র মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিকতা-বিবেক, সহনশীলতা-ধৈর্য এবং পরার্থপরতা বা কল্যাণ করার মানসিকতা চরিত্রের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। শিক্ষা যদি কাউকে চাকুরিমুখী না করে চরিত্রমুখী করে, তাহলে চাকুরির সাথে চরিত্র মিলবে; ফল পাবে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র। আর শিক্ষা যদি কাউকে চরিত্রমুখী না করে শুধু চাকুরিমুখী করে, তাহলে ব্যক্তি হয়তো চাকুরি পাবে, কিন্তু তাতে মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো উপকার হবে না। বরং সমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রবাদে আছে— “চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান”।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু সামরিক, বেসামরিক বা আধা-সামরিক অফিসারদের মাঝে সমাজে দুর্নীতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে। তাদের সকলের মাঝে শিক্ষা আছে, কিন্তু ভালো চরিত্র নেই, তাই সমাজ তাদের থেকে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি পেয়েছে। তারা ভালো চরিত্রের অধিকারী হলে দেশের সম্পদ দেশেই থাকত এবং অনেক মানুষের জীবনে এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা আসত না। প্রবাদে আছে— “যার চরিত্র শেষ, তার সবকিছু শেষ”। তাহলে শুধু শিক্ষাই একজনের জীবনকে সফলতার শিখরে নিতে পারে না। যদি শিখরে পৌঁছেও যায়, তবুও দেখা যায় চরিত্রহীনতার কারণে আবার পতন হয়েছে।
শুধু দুর্নীতিই নয়, বরং অসম্মানজনক অপমান, হেয় প্রতিপন্ন করা, লাঞ্ছনা করা, উত্যক্ত করার মতো ঘটনাও হরহামেশা ঘটে চলেছে; এমনকি শিক্ষিত মানুষের দ্বারা ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধিও আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে। যারা এসব কাজ করেছে, তাদের সকলেরই শিক্ষা আছে, কিন্তু ভালো চরিত্রের অভাব রয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়শই দেখা যায় শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা, যেগুলো সমাজকে পীড়া দেয়। এসব কাজ শুধু চরিত্রের অভাবেই হয়।
চরিত্র গঠনের বিভিন্ন উপাদান আছে সমাজে। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহপাঠী, সহকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্কের মাধ্যমে তা গড়ে উঠতে পারে। পাঠ্যাভ্যাস বাড়ানো, গ্রামীণ সমাজে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও অংশগ্রহণও ভালো চরিত্র গঠনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে যে সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের মধ্যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ শিক্ষার্থীদের উন্নত চরিত্রের বিষয়টি মাথায় রেখে কারিকুলামে নৈতিকতা, ধর্মীয় কোর্স, তুলনামূলক ধর্ম ও দর্শনের আলোচনার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে। উত্তম চরিত্র গঠন ও শিক্ষা-পরবর্তী সময়ে সৎভাবে কাজ করার উপর বিভিন্ন সময়ে ধারাবাহিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করেছে।
শিক্ষা এবং চাকুরি বা শিক্ষা এবং চরিত্র—কোনোটাই পরস্পরবিরোধী নয়; বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। সামষ্টিক কল্যাণের জন্য শিক্ষার সাথে চরিত্রের বিষয়টি অতীব জরুরি। চাকুরির লক্ষ্যে না ছুটে ভালো মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার জন্য উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। তাতে করে দেশ এগিয়ে যাবে, সমাজ এগিয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক:
মোঃ তাজুল ইসলাম
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
পিএইচ.ডি গবেষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার, ঢাকা–১৩৪২
২৩০ বার পড়া হয়েছে