আদর্শের কথা বলে আখতারুজ্জামানকে দলে: জামায়াত কি এখন সুযোগসন্ধানীদের শেষ আশ্রয়স্থল?
রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১২:০৩ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
নির্বাচনের হাওয়ায় ভেসে জামায়াতে ইসলামী এখন নতুন এক নাটকের মঞ্চ সাজিয়েছে—মুখে “সৎ লোকের শাসন” আর “আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা”, কাজে দলে টেনে নিচ্ছে বারবার বহিষ্কৃত, বিতর্কিত রাজনীতিককে।
একদিকে খুলনায় সংখ্যালঘু একজনকে মনোনয়ন দিয়ে সহনশীলতার নমুনা দেখানোর অভিনয়, অন্যদিকে মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের মতো সুযোগসন্ধানী চরিত্রকে বুকে টেনে নিয়ে আদর্শের সব কথাকে ঠেলে দিচ্ছে কেবল ভোটের অঙ্কের খাতায়। এই দুই দৃশ্য একসঙ্গে দাঁড় করালে জামায়াতের দ্বিচারিতা এতটাই নগ্ন হয়ে ওঠে যে, “আল্লাহর আইন” এখানে নীতি নয়, কেবল ক্ষমতার পথে প্যাকেটবন্দি স্লোগান বলেই স্পষ্ট হয়।
নির্বাচন ঘনিয়ে এলে জামায়াতের পথ
জামায়াত প্রকাশ্যে বলছে, তারা “সৎ, আল্লাহভীরু লোকের শাসন” কায়েম করতে চায়, কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে তিনটি কৌশল—মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইমেজ ধুয়ে ফেলা, বিএনপি ঘরানার ভাঙা-মাথা নেতাদের কুড়িয়ে নেওয়া, আর সংখ্যালঘু–উদার ইমেজ তৈরি করে আন্তর্জাতিক মহলে বার্তা পাঠানো।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে—আদর্শের চেয়ে অনেক বেশি দরকষাকষি, সিগনাল রাজনীতি আর ভবিষ্যৎ ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার লোভে তাদের স্ট্র্যাটেজি বদলাচ্ছে।
‘সৎ লোকের শাসন’ ন্যারেটিভ বনাম আখতারুজ্জামান
একজন মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও এমপি—এই পরিচয় ব্যবহার করে জামায়াত বোঝাতে চায়, তারা নাকি এখন আর “স্বাধীনতাবিরোধী” না, বরং মুক্তিযোদ্ধাকেও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব মনে করে।
কিন্তু যে মানুষটি বিএনপি থেকে পাঁচবার বহিষ্কৃত, ২০২৪-এর সরকার–নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হাসিনার গুণকীর্তনে মেতেছিলেন, আজ তিনি হঠাৎ জামায়াতে গিয়ে “সৎ শাসন”“আল্লাহর আইন”–এর কথা বললে সেটা আদর্শ নয়, নিখাদ রাজনৈতিক বাজার বদল—এই সত্য কোনভাবেই ঢেকে রাখা যায় না।
দ্বিচারিতা: মুখে আল্লাহর আইন, কাজে সুযোগসন্ধান
একদিকে জামায়াত বলে, তারা “আল্লাহর আইন” প্রতিষ্ঠা করতে চায়, অন্যদিকে সেই আইন প্রতিষ্ঠার প্রথম উদাহরণ হিসেবে যে মানুষটিকে বেছে নেয়, তার নিজের রাজনৈতিক অতীতই ভাঙা আনুগত্য, স্ববিরোধিতা আর পদলোভী রাজনীতির খতিয়ান।
এটা মূলত জামায়াতের ওই পুরনো দ্বিচারিতারই নতুন সংস্করণ—ঘোষণাপত্রে নৈতিকতা, মাঠে টিকিট দেওয়া হয় এমন লোককে, যার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো “বেঁচে থাকা” আর “যে দিকে হাওয়া, সে দলে ভিড়ে যাওয়া”।।
খুলনায় সংখ্যালঘু প্রার্থী: টোকেন নাকি আদর্শ?
খুলনায় এক সংখ্যালঘু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে জামায়াত এখন প্রোপাগান্ডা তুলেছে—দেখো, “আমরাই তো প্রকৃত সহনশীল, আমরা সংখ্যালঘুকেও সম্মান দিই”।
কিন্তু একই দল তার তাত্ত্বিক কাঠামোয় অমুসলিমকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ধারণা থেকে বেরোয় না, সংবিধান–বিরোধী দ্বৈত আইনকাঠামো চায়, আর বাস্তবে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কখনও ধারাবাহিক রাজনৈতিক অবস্থান নেয় না—তাহলে এই মনোনয়ন নীতি নয়, নিছক নির্বাচনী টোকেনিজম, এক ধরনের রাজনৈতিক মেকআপ ছাড়া আর কিছুই না।
আল্লাহর আইনকে ভোটের স্লোগান বানানোর বিপদ
আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা—এটা যদি সত্যি কারও আকাঙ্ক্ষা হয়, তাহলে তার প্রথম শর্ত হচ্ছে ন্যায়–বিচার, সত্যবাদিতা, জবাবদিহিতা আর নৈতিক দৃঢ়তা, যা নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
জামায়াত যখন এই নাম ব্যবহার করে এমন মানুষকে সামনে আনে, যে নিজের কথার সঙ্গে, নিজের অতীত অবস্থানের সঙ্গেই সৎ থাকতে পারেনি, তখন সেটা আল্লাহর নামকে রাজনৈতিক পণ্যে পরিণত করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না—এটা ধর্মদ্রোহিতার সূক্ষ্ম, কিন্তু ভয়াবহ এক রূপ।
মুখোশ খুলে দেখানো
এই সব কিছুর ভেতর থেকে যে কড়া বার্তাটা টেনে নেওয়া যায়, তা একদম সোজা:
* জামায়াত আজ আদর্শের দল নয়, বরং “রিব্র্যান্ডিং–নির্ভর পাওয়ার ব্রোকার” রাজনৈতিক কোম্পানি।
* “সৎ লোকের শাসন” স্লোগান শুধু মাইকে বাজে; প্রার্থী বাছাইয়ে টাকা, প্রভাব, মিডিয়া ভ্যালু আর ভোটের অঙ্কই চূড়ান্ত ফ্যাক্টর।
* খুলনার সংখ্যালঘু প্রার্থী হোক, বা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান—দুজনই এই দলের কাছে মূলত ইমেজ–ধোলাইয়ের প্রপস, আদর্শিক শর্ত পূরণকারী মানুষ নয়।
“সৎ লোকের শাসন”–এর দাবির সঙ্গে এই দুই উদাহরণের তীব্র বৈপরীত্য, মাঝে জামায়াতের অতীত–বর্তমান ন্যারেটিভ ভেঙে দেওয়া, শেষে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া—আল্লাহর আইন কি সত্যি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, নাকি ভোটের বাজারে আল্লাহর নামটাই সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড হয়ে গেছে?
কথায় এক, কাজে আরেক—এই ধরনের ভণ্ডামি ও দ্বিচারিতার প্রসঙ্গ পবিত্র কোরআনে সরাসরি এসেছে, বিশেষ করে মুনাফিকদের কথা বলতে গিয়ে।
সূরা আস-সফ (الصف), আয়াত ২–৩ এ আল্লাহ বলেন, মুমিনদের উদ্দেশে প্রশ্ন করা হয়েছে: কেন তোমরা এমন কথা বলো, যা তোমরা করো না—এবং বলা হয়েছে, যা করো না, তা বলা আল্লাহ’র নিকট অত্যন্ত ঘৃণার বিষয়।
সূরা (آل عمران) আল ইমরান ৩:১৬৭, সূরা (الفتح) আল ফাতহ ৪৮:১১–তেও এসেছে, এমন এক শ্রেণির লোকের কথা, যারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই; অর্থাৎ মুখের কথা ও অন্তরের বিশ্বাস/কর্ম ভিন্ন।
পুরো সূরা (المنافقون) আল মুনাফিকুন (সূরা ৬৩) মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেখানে দেখানো হয়েছে তারা মুখে ঈমান ও আনুগত্যের দাওয়ি করলেও বাস্তবে মানুষের পথ রোধ করে, বিভাজন সৃষ্টি করে, আর নিজেদের স্বার্থের জন্য দ্বিমুখী আচরণ করে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২০ বার পড়া হয়েছে