খালেদা-তারেক অনুপস্থিত, তবু নির্বাচনমুখী বিএনপি: নেতৃত্ব সংকট
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৫:৩২ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বিএনপির নেতৃত্বের কেন্দ্র বরাবরই ঘুরে এসেছে প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের চারপাশে।
বর্তমানে সেই ধারার দুই মুখ্য ব্যক্তি—চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান—দুজনেই কার্যত মাঠের বাইরে। খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে, তাঁকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতিও অনিশ্চয়তায় ঝুলে আছে। অন্যদিকে তারেক রহমান প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত তাঁর একার হাতে নেই; রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সংবেদনশীলতার কারণে সব ব্যাখ্যাও তিনি দিতে পারছেন না। এই অবস্থার মধ্যেই বিএনপি নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী চূড়ান্তকরণ ও প্রচারণা–প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা দলীয় ভেতরে ও জনমনে নেতৃত্ব–সংকট নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার্যত ঝুলে আছে
জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ধারার উত্তরসূরি হিসেবে খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তের কেন্দ্র ছিলেন; পরবর্তীতে তারেক রহমান ধীরে ধীরে সেই নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় সামনে এসেছেন। এখন ৮০–এর কোঠায় থাকা খালেদা জিয়া বহুবিধ গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছেন। নিবিড় পরিচর্যার বাইরে তাঁকে রাখা যাচ্ছে না এবং শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে লন্ডনে নেওয়ার বিষয়টি চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট মহলের আলোচনায় আছে। প্রায় দেড় যুগ ধরে লন্ডনে থাকা তারেক রহমান আবার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দেশে ফেরার সুযোগ “পুরোটাই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই” এবং নির্বাচনের আগে এই প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে তাঁরও সীমাবদ্ধতা আছে।
ফলে, যাদের চারপাশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রেখা আঁকা হয়েছে, সেই দুই মূল ব্যক্তিত্ব এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে; তাঁরা কবে এবং কীভাবে সরাসরি নেতৃত্বে ফিরতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট নয়। এই ঝুলে থাকা কেন্দ্রই বর্তমান সব রাজনৈতিক অঙ্কে সবচেয়ে বড় অজানা।
নির্বাচন থামছে না, কিন্তু ফাঁক স্পষ্ট
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী তালিকা, আসনভিত্তিক সমীকরণ ও মাঠের প্রস্তুতি—এসব নিয়ে বিএনপির ভেতরে কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। নির্ধারিত সময়সীমার ভেতরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে দলটি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এবং কোনো “অকারণ বিলম্ব” নিয়ে তারা উদ্বেগও জানিয়ে এসেছে। এ বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া, তাঁর সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থা এবং তারেক রহমানের অনিশ্চিত প্রত্যাবর্তন—এসব কোনো কিছুই নির্বাচন ক্যালেন্ডারকে থামিয়ে রাখছে না।
এটা একদিকে বাস্তবতার স্বীকৃতি—রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংকটে থেমে থাকে না; আবার অন্যদিকে, বিএনপির ভেতরে নেতৃত্ব–শূন্যতার প্রশ্নটাকেও আরও স্পষ্ট করে তোলে। নির্বাচন সামনে এগোলেও, এই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত দায় কার কাঁধে—সেই উত্তর মাঠের পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছেও পরিষ্কার না থাকায় ঝুঁকি বাড়ছে ।
প্রার্থী বাছাইয়ে নতুন প্রভাবশালী মহল
প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করা, কে কোন আসনে দাঁড়াবেন, কাকে কেন্দ্রীয়ভাবে “গ্রহণযোগ্য” বা “ঝুঁকিমুক্ত” ধরা হচ্ছে—এসব সিদ্ধান্ত এখন মূলত স্থায়ী কমিটি, সংশ্লিষ্ট উপকমিটি ও কিছু প্রভাবশালী নেতার আলোচনায় নির্ধারিত হচ্ছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুটি মুখ সক্রিয়ভাবে সরাসরি প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে না থাকায়, স্বাভাবিকভাবেই কিছু মধ্যম ও উচ্চ–স্তরের নেতার প্রভাব এখানে বাড়ছে—মনোনয়ন প্রস্তাব দেওয়া, নাম বাদ দেওয়া, আসন বদল, জোট সমীকরণ—এসবের মধ্য দিয়ে তাঁরা ভবিষ্যৎ অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার অবস্থানও গড়ে নিচ্ছেন।
এ প্রক্রিয়াকে কেউ দেখছেন দলকে সচল রাখার প্রয়াস হিসেবে; কেউ আবার আশঙ্কা করছেন, এর মধ্য দিয়েই বিএনপির ভেতরে নতুন নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে উঠছে—যা পরে নীতি–নির্ধারণ, আন্দোলন কৌশল কিংবা সরকারে গেলে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রশ্নে বড় ভূমিকা নিতে পারে।
জনমনে প্রশ্ন: শীর্ষ নেতৃত্ব বাইরে, সিদ্ধান্তে কার কর্তৃত্ব?
এই সব কিছুর পটভূমিতে জনমনে এবং কর্মীদের মধ্যে যে প্রশ্নগুলো ঘুরছে, তা মূলত তিন দিক ঘিরে—
একটি ঐতিহাসিক নেতৃত্বের ধারক দল হিসেবে বিএনপি কি এখন “আন্দোলন–কেন্দ্রিক উত্তরাধিকার” থেকে “নির্বাচন–কেন্দ্রিক বাস্তববাদী সমীকরণে” সরে যাচ্ছে?
শীর্ষ নেতৃত্ব চিকিৎসা ও নির্বাসনে ব্যস্ত থাকায়, প্রার্থী বাছাই ও মাঠ–পর্যায়ের অনেক সিদ্ধান্তে প্রকৃত কর্তৃত্ব কে প্রয়োগ করছেন—এটা কি আনুষ্ঠানিক গঠনতন্ত্রে প্রতিফলিত, নাকি অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তিগত নৈকট্য–নির্ভর?
সামনে যদি খালেদা জিয়া পূর্ণ রাজনৈতিক সক্রিয়তায় ফিরতে না পারেন এবং তারেক রহমানের ফেরাও আরও পেছায়, তাহলে এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কি বিএনপির ভেতরে নতুন নেতৃত্ব–মানচিত্র নির্ধারণ করে দেবে?
এই প্রশ্নগুলোর প্রকাশ্য ও সরাসরি উত্তর এখনো মেলেনি। তবে বাস্তব ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য শুধু সংসদীয় আসন পাওয়ার লড়াই নয়—এটা একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যেরও পরীক্ষাক্ষেত্র।
সামনে পথ কোনদিকে?
খালেদা জিয়ার শারীরিক সংকট, তারেক রহমানের সীমাবদ্ধ অবস্থান, আর তার মাঝখানে প্রার্থী–কেন্দ্রিক নির্বাচনী ব্যস্ততা—এই তিনটি বাস্তবতা মিলিয়ে বিএনপি এখন স্পষ্ট এক রূপান্তরের মুখোমুখি। একদিকে তারা নিজের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখতে চাইছে; অন্যদিকে বাস্তব নির্বাচনী রাজনীতির কঠিন ক্যালেন্ডারের চাপও মেনে নিচ্ছে।
এই দ্বৈত চাপ সামাল দিতে গিয়ে দল যদি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত–প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পারে, তাহলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাময়িক অনুপস্থিতিও সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি সিদ্ধান্তের ভার মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় এবং নেতাকর্মীদের কাছে নেতৃত্ব–প্রশ্নের স্বচ্ছ উত্তর না পৌঁছায়, তাহলে নির্বাচনের পর বিএনপির ভেতরেই নতুন ধরনের অস্থিরতা এবং বিভাজনের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১১৫ বার পড়া হয়েছে