পুতিন-ট্রাম্পের মাঝপথে মোদি: দিল্লি সমিট শেষ, কূটনৈতিক দড়ি টানাটানি শুরু
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:১৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ৩০ ঘণ্টার ভারত সফর শেষ হয়েছে, তিনি দিল্লি থেকে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছেন।
এই স্বল্প কিন্তু ঘনিষ্ঠ সফরে পুতিন–মোদি জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য বাড়ানোর ঘোষণার পাশাপাশি এমন এক বার্তা দিয়েছেন, যা সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অক্ষকে চ্যালেঞ্জ করে।
“মাই ফ্রেন্ড” থেকে “টাইম–টেস্টেড ফ্রেন্ড”
ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুবার নরেন্দ্র মোদিকে “মাই (গ্রেট) ফ্রেন্ড” বলে উল্লেখ করে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ইমেজ সামনে এনেছিলেন, যা ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে উষ্ণ দেখিয়েছে। এখন সেই জায়গায় পুতিনও প্রকাশ্যে মোদিকে নিজের “বন্ধু” এবং “বিশ্বস্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ নেতা” হিসেবে প্রশংসা করে দিল্লির সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ককে নতুন গতি দিচ্ছেন, বিশেষ করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে।
১০০ বিলিয়ন বাণিজ্য ও ‘অবিচ্ছিন্ন’ রাশিয়ান তেল
দিল্লি সমিটে দুই নেতা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, যেখানে ইতিমধ্যে রাশিয়ান তেল ভারতের আমদানি ঝুড়ির বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। পুতিন ভারতের জন্য “অবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের” প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা সস্তা তেলের নিশ্চয়তা দিলেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও মার্কিন চাপকে আরও ঘনীভূত করতে পারে।
ট্রাম্পের ট্যারিফ বনাম পুতিনের তেল–অফার
অপরদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর উচ্চ ট্যারিফ আরোপ করে “বন্ধু হলেও ছাড় নয়” বার্তা দিয়েছে এবং রাশিয়ান তেল কেনা ইস্যুতে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানাচ্ছে। ফল হিসেবে, একসময়কার “মাই ফ্রেন্ড মোদি”–ইমেজের আড়াল থেকে এখন প্রকাশ পাচ্ছে কঠোর বাণিজ্যনীতি, স্যাংশন–ঝুঁকি এবং কৌশলগত সন্দেহের বাস্তবতা, যা দিল্লিকে এক অস্বস্তিকর দোদুল্যমানতায় ফেলে দিয়েছে।
ইউক্রেন প্রশ্নে দ্ব্যর্থতা, ইসরাইল–রাশিয়া দুই প্রান্তে
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে একাধিকবার ভোটদানে বিরত থেকে সরাসরি রাশিয়াকে অভিযুক্ত করা এড়িয়ে গেছে, আবার ভাষায় “সার্বভৌমত্ব”, “আলোচনা” ও “শান্তি”র কথা বলেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা গভীর করেছে, আর রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব ধরে রেখেছে—ফলে ভারতকে অনেকের কাছে “দুই শিবিরেই অর্ধেক পা রাখা” শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
চীন–পাকিস্তান–বাংলাদেশ ঘিরে আঞ্চলিক টানাপোড়েন
উত্তরে চীন ও পশ্চিমে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতা ভারতের প্রতিরক্ষা–নীতিকে স্থায়ী চাপের মধ্যে রেখেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্তে সংঘাত ও উস্কানিতে সেই উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও রাজনৈতিক আস্থার টানাপোড়েন নতুন একটি উদ্বেগের রেখা তৈরি করেছে, যা দিল্লির “ব্যাকইয়ার্ড”–এ চীনসহ অন্য শক্তির প্রভাব বাড়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।
পুতিন চলে গেলেন কিন্তু কি থেকে গেল?
পুতিনের দিল্লি সফর শেষ হওয়া মানে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সমাপ্তি নয়; বরং মোদির জন্য আরও জটিল কূটনৈতিক হিসাবের শুরু। সামনে তার কাছে বড় প্রশ্নগুলো হচ্ছে—রাশিয়ার সস্তা তেলের ওপর নির্ভরতা রেখে কতটা দূর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ ও নিষেধাজ্ঞার চাপ সামলাতে পারবেন, এবং একই সঙ্গে চীন–পাকিস্তান–বাংলাদেশ–ইসরাইল–রাশিয়া–যুক্তরাষ্ট্র—এই বহুস্তরীয় অক্ষের মাঝেও কি করে ভারতের স্বার্থ–কেন্দ্রিক স্বাধীন অবস্থান টিকিয়ে রাখবেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২০ বার পড়া হয়েছে