সর্বশেষ

জাতীয়ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট উৎসবমুখর হবে: ড. ইউনূস
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় আসছেন আজ
সারাদেশউত্তরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহের আভাস, তাপমাত্রা নেমে বাড়ছে দুর্ভোগ
আন্তর্জাতিকশ্রীলঙ্কায় ‘দিতওয়া’: বন্যা-ভূমিধসে মৃত্যু ৪১০, নিখোঁজ শতশত
কানাডার মন্ত্রি স্টিভেন গিলবোল্টের পদত্যাগের পর মন্ত্রিসভায় ক্ষুদ্র রদবদল
খেলাবিরাট কোহলি ১৫ বছর পর ঘরোয়া ক্রিকেটে, বিজয় হাজারে ট্রফিতে দিল্লির হয়ে খেলবেন
ফিচার

আজ সেই ৩ ডিসেম্বর

নাম জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে: দূরদেশের এক মানুষের হৃদয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধ

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:৩৪ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
শরণার্থী শিবিরের সেই শীতল সন্ধ্যাটা যেন আজও ইতিহাসের বুক জুড়ে কাঁপতে থাকা এক দীর্ঘশ্বাস। ক্ষুধায় কাতর শিশু, ঘরে না ফেরা মানুষের আর্তনাদ আর মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া রোগ—সব মিলিয়ে ১৯৭১ সালের শরণার্থী বাস্তবতা ছিল এক অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়।

সেইরকম এক সময়েই, দূর দেশের এক তরুণ ফরাসি– জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে–নিজের জীবনকে বাজি রেখে বাংলাদেশের নামে লিখে দেন এক অসম্ভব সাহসের মহাকাব্য।

দূরদেশের এক অস্থির তরুণ

জ্যঁ ক্যুয়ে তখন স্রেফ ২৮ বছরের এক অস্থির ফরাসি যুবক; নিতান্ত সাধারণ, নাম না জানা ভিড়েরই একজন। কিন্তু সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় তিনি দেখছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) গণহত্যা, নির্বাসিত মানুষের সারি আর ভারত সীমান্তের ওপারে শরণার্থী শিবিরে জমে ওঠা অন্তহীন কষ্টের কাহিনি। তাঁর বুকের ভেতর তোলপাড় করে তুলছিল একটাই প্রশ্ন—“এত অন্যায় দেখেও যদি কিছুই না করি, তাহলে মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্বের মানে কী?”
এভাবেই ধীরে ধীরে তাঁর ভেতরে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত, অনেকের চোখে ‘উন্মাদ’ অথচ গভীর মানবতাবাদী পরিকল্পনা। তিনি বুঝে যান, কেবল বিবৃতি, মিছিল বা প্রবন্ধ দিয়ে বিশ্বশক্তিদের নড়ানো যাবে না; দরকার এমন একটা ঘটনা, যা হঠাৎই খবরের শিরোনাম পাল্টে দেবে, আর বিশ্বজুড়ে মানুষ জানতে চাইবে—“বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য এমন পাগলামি করতে একজন ফরাসি কেন বাধ্য হলো?”


অর্লি বিমানবন্দরের রুদ্ধশ্বাস সকাল

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দর সকালটা ছিল অন্য সব দিনের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক। জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিদুর নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত সবাই; সেই সুযোগে, কালো কোটের ভাঁজে লুকোনো একটি পিস্তল আর বুকভরা সংকল্প নিয়ে জ্যঁ ক্যুয়ে হেঁটে যান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পিকে–৭১২ এর দিকে। বিমানের গায়ে লেখা—“সিটি অব কুমিল্লা”—হয়তো তখনও বোঝাই যায় না, এই উড়োজাহাজই কয়েক মুহূর্ত পর বাংলাদেশের পক্ষে এক ঐতিহাসিক নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠবে।
বিমানে উঠে তিনি আর পাঁচজন যাত্রীর মতই আসনে বসে পড়েন, যেন কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। কিন্তু দরজা বন্ধ হওয়ার আগে হঠাৎ দাঁড়িয়ে তিনি সোজা ককপিটের দিকে এগিয়ে যান, বের করেন ৯ মিলিমিটার পিস্তল, এবং পাইলটকে নির্দেশ দেন–ইঞ্জিন বন্ধ করে বিমানকে মাটিতেই স্থির রাখতে। ভীতসন্ত্রস্ত যাত্রীদের সামনে তিনি নিজেই ঘোষণা করেন, তাঁর লক্ষ্য টাকা নয়, কোনো ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়—তাঁর লক্ষ্য বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের জন্য ওষুধ।

দাবি– মাত্র ২০ টন ওষুধ

জ্যঁ ক্যুয়ে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন তাঁর শর্ত: যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) শরণার্থীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী এই বিমানে তুলে দিতে হবে। তিনি বললেন, যত ওষুধ এর ভেতরে তোলা সম্ভব, ততই তিনি নিতে রাজি—কিন্তু ওষুধগুলো যেতে হবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য, অন্য কোথাও নয়।
ফরাসি কর্তৃপক্ষ প্রথমে হতবিহ্বল; পাকিস্তানি কূটনৈতিক মহল ক্ষুব্ধ; কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া দ্রুত ভিড় করতে শুরু করল অর্লির রানওয়ে ঘিরে। এক ফরাসি যুবকের ‘অপরাধ’ হঠাৎই মানবতার পক্ষের দৃঢ় অবস্থান হয়ে উঠল—যে মানুষ নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও বাংলাদেশকে বলতে চাইছে, “তোমাদের কষ্ট আমি দেখেছি, তোমাদের জন্য আমি দাঁড়িয়েছি।”

রক্তাক্ত নয়, মানবিক এক ‘হাইজ্যাক’

এই নাটকীয় জিম্মি পরিস্থিতিতেও জ্যঁ ক্যুয়ে একটাও গুলিও চালাননি; যাত্রীদের গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেননি—মুখে শুধু একটাই কথা, “আমি এই কাজ করছি পূর্ব পাকিস্তানের নিহত শিশুদের পক্ষ থেকে।” যাত্রীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি তাঁদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে তিনি কারও ক্ষতি করবেন না; তাঁর লড়াই কেবল আন্তর্জাতিক বিবেক জাগানোর জন্য।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা উত্তেজনার পর ফরাসি কর্তৃপক্ষ ও মানবিক সংস্থাগুলো ওষুধ পাঠাতে সম্মত হয়; বিমানে প্রতীকীভাবে ওষুধের কার্টন তোলা শুরু হয়, আর জনমতের চাপে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ওষুধ–ত্রাণ পাঠানোর পথ বাস্তবে খুলে যায়। যখন জ্যঁ ক্যুয়ের দু’হাত ব্যস্ত ছিল ওষুধের বাক্স নিতে, তখনই স্বেচ্ছাসেবক সেজে থাকা পুলিশ সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে নিরস্ত্র করে ফেলে—রুদ্ধশ্বাস নাটকের পর্দা নামে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম লেখা শেষ হয় না।

কারাগারে বন্দি, কিন্তু কৃতজ্ঞতার আকাশজোড়া মুক্তি

আইনের চোখে তিনি অপরাধী; বিমান ছিনতাই, অস্ত্র নিয়ে জিম্মি করা—সবকিছুর কঠোর বিচার হলো ফরাসি আদালতে। কিন্তু সেই আদালতের বাইরে, আর হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে এক নতুন জন্ম নেওয়া দেশ–বাংলাদেশ তাঁকে মনে রাখল অন্যভাবে—একজন অপরিচিত বন্ধুর মতো, যে একদিন নিজের সবকিছু ঝুঁকিতে রেখে এই দেশের শরণার্থীদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দিতে চেয়েছিল।
ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মালরোর বক্তব্য ও বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর অঙ্গীকার জ্যঁ ক্যুয়েকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল; মালরো পরে তাঁর আইনগত সহায়তার ব্যবস্থাও করেন, যা এই কাহিনিকে আরও মানবিক মাত্রা দেয়। সরকারী পদক বা আনুষ্ঠানিক সন্মাননার দীর্ঘ তালিকা হয়তো তাঁর নামে নেই, কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশি মহল, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক আর নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা তাঁকে স্মরণ করে তৈরি করেছে প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, এমনকি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র—“জেকে ১৯৭১” সেই শ্রদ্ধারই এক দৃষ্টিনন্দন বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের স্মৃতিতে জ্যঁ ক্যুয়ে

আজ যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আন্তর্জাতিক অধ্যায় লেখা হয়, তখন জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ের নামটি উঠে আসে নিঃশব্দ, নিঃস্বার্থ এক বন্ধুর প্রতীক হিসেবে, যে বিনিময়ে কিছুই চায়নি—চেয়েছিল শুধু আহত এক জাতির পাশে দাঁড়াতে। বাংলাদেশের সাংবাদিক, লেখক ও সাধারণ মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলেন—একটি গুলিও না ছুড়ে, একটি প্রাণও না নিয়ে, তিনি প্রমাণ করেছিলেন সাহস মানে শুধু অস্ত্র নয়, সাহস মানে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছাশক্তি।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

১২০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন














সর্বশেষ সব খবর
ফিচার নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন