বাংলাদেশে ভূমিকম্প: ইতিহাস, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও ভয়াবহতার সতর্কবার্তা
শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫ ৬:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও আশেপাশের এলাকায় প্রতি বছর ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে।
২০১৭ সালে ২৮টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিলো, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৪১টি এবং ২০২৪ সালে ৫৪টিতে পৌঁছায়। দিন দিন বেড়েই চলছে ভূমিকম্পের প্রবনতা। তাই সামনে আরো বড় ধরণের অর্থাৎ ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হওয়ার ধারণা করছে গবেষকরা।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বাংলাদেশের অবস্থান সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় দেশটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘনবসতি এলাকা, পুরোনো ও দুর্বল অবকাঠামো এবং কঠোরভাবে কার্যকর না হওয়া বিল্ডিং কোড এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যদি অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তারা সরকারের কাছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইতিহাসে শক্তিশালী ভূমিকম্প
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৮১৮ ও ১৮২২ সালে। ১৮২২ সালে সিলেটে ৭.৫ মাত্রার এবং শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে।
সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকা অঞ্চলে ১৫৪৮, ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৭৬২, ১৭৬৫, ১৮১২, ১৮৬৫ ও ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেই সময়ের যন্ত্রপাতির অভাবে সঠিক মাত্রা জানা যায়নি।
গত ১২০–১২৫ বছরে বাংলাদেশে মাঝারি ও বড় মাত্রার প্রায় একশ’র মতো ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা সীমিত।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প
২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের আসাম রাজ্যের মরিগাঁও থেকে উৎপত্তি হওয়া ৫.৩ মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে অনুভূত হয়।
এরপর ৫ মার্চ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিলো ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা। ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ছিলো ৪৪৯ কিলোমিটার।
১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের আসাম রাজ্য।
২১ সেপ্টেম্বর সিলেটের ছাতক থেকে উৎপত্তি হওয়া ৪ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই ভূমিকম্প বেলা সাড়ে ১২টার পরে হয় এবং ঢাকা থেকে উৎপত্তিস্থল ১৮৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ছিলো।
২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৬ জুন ৪.৫ মাত্রার একটি মৃদু ভূমিকম্প সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে উৎপত্তি হয়। ২০২৩ সালের ৫ মে ঢাকা ও আশপাশে ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে। উৎপত্তিস্থল ছিলো বিক্রমপুরের দোহার, ঢাকা থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। গভীরতা ছিলো মাত্র ১০ কিলোমিটার। ২ ডিসেম্বর ২০২৩ সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হয়।
গত প্রায় ৫শ' বছরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প
২৫ এপ্রিল ২০১৫: নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প, প্রায় ৯ হাজার প্রাণহানি। কম্পন বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, চীনসহ আশপাশের দেশেও অনুভূত হয়।
৪ জানুয়ারি ২০১৬: ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে, আতঙ্কে ছয়জন প্রাণ হারান।
১৯৯৯ জুলাই: মহেশখালী দ্বীপে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত।
১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর: চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প, শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় ফাটল।
১৯১৮: শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প, মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও অনুভূত।
১৯৫০: ভারতের অরুণাচল প্রদেশে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি।
১৯৩৪: বিহারে ভূমিকম্পের প্রভাব বাংলাদেশেও অনুভূত হয়।
১৮৯৭: ১২ জুন শিলং প্ল্যাটোতে ৮.২ মাত্রার ভূমিকম্প, মেঘালয়, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় ১৬০০–র বেশি প্রাণহানি।
১৮৮৯: ১০ জানুয়ারি মেঘালয়ে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, সিলেট শহরসহ আশপাশের এলাকায় কম্পন অনুভূত।
১৮৮৫: মধুপুর ফল্টে ৬.৫–৭.০ মাত্রার ভূমিকম্প, বাংলাদেশের ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি।
১৭৮৭: শিলং প্ল্যাটোতে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প, ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন।
১৭৬২: টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ৮.৫+ মাত্রার ভূমিকম্প, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ৩ মিটার উঁচুতে উঠে আসে, বঙ্গোপসাগরে সুনামি, প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু।
১৫৪৮: আসামে বড় ভূমিকম্প, অঞ্চলটির ভূ-গঠনে পরিবর্তন।
ঢাকার বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা—এই তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্বে সঞ্চিত শক্তি যে কোনো মুহূর্তে ৮–৯ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় এ ধরনের ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ২০২৩ সালে বলেছিলেন, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও বর্তমান ভবনের গঠন ও জনঘনত্বের কারণে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে।
ভূমিকম্পের কারণ
একসময় পৃথিবীর সব স্থলভাগ একসঙ্গে যুক্ত ছিলো। পরে প্লেটগুলো আলাদা হয়ে যায়। প্লেটগুলোর সংঘর্ষে শক্তি সঞ্চিত হয়ে সিসমিক তরঙ্গ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। ভূত্বককে কাঁপিয়ে দেয়, যা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভূত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর-পূর্বের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা এবং হিমালয়ের পাদদেশের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলিতে ভূমিকম্পের সংখ্যা বাড়ছে। এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়ছে।
১৮০ বার পড়া হয়েছে