সারাদেশে সহিংসতায় বাড়ছে আতংক, কোন পথে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫ ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। যতই নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে দেশে বেড়ে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা মতানৈক্য।
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রস্তুতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়ছে আতংক।
গত সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুরসহ আটটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া তিনটি স্থানে যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া লিংক রোডে মুন্নু ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী বহনকারী একটি খালি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। গভীর রাতে আরও তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। যদিও এসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি, তবু রাজধানীজুড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় গভীর রাতে বাসে অগ্নিসংযোগে ঘুমন্ত এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাজশাহীতেও আওয়ামী লীগের একটি পরিত্যক্ত কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে নাশকতার আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে সাধারণ মানুষ এখন উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, যেকোনো পরিস্থিতিতেই ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণাকে ঘিরে সম্ভাব্য অস্থিরতা নিয়ে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বোচ্চ স্তরে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'প্যাট্রোলিং বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং কেপিআই এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া খোলা তেল বিক্রি বন্ধসহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।'
রায়কে কেন্দ্র করে কোনো অরাজকতা বা সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের টহল, মোবাইল ও পিকেট পার্টি সক্রিয় করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, কিছু রাজনৈতিক দল অনলাইন ও অফলাইনে সংঘবদ্ধ প্রচারণার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের আশঙ্কায় কঠোর সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা ভারতের মদতে আবারও দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ৫ নভেম্বর এক ভিডিও বার্তায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ‘১৩ নভেম্বর লকডাউন’-এর ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো বড় ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে নানক বলেন, ‘১৩ নভেম্বরকে সামনে রেখে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। ঢাকায় আমরা ১৩ নভেম্বর লকডাউন দিয়েছি। সকাল-সন্ধ্যা লকডাউন।’ জাহাঙ্গীর কবির নানক আরো বলেন, ১০, ১১, ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল এবং ১৩ নভেম্বর যেন রাজধানী ঢাকা শহর আমাদের দখলে থাকে, জয় বাংলার দখলে থাকে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতের ঘোষণা, যার লক্ষ্য রায় ঘোষণাকে ঘিরে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।
শেখ হাসিনার রায় ঘিরে জাহাঙ্গীর কবির নানকের এই ভিডিও প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ঢাকা শহর এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝটিকা মিছিল করেছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে বড় আকারের নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জনরোষে বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবারও ভারতীয় সহায়তায় দেশে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে চায়- প্রশাসনে তাদের অনুগতদের দিয়ে ঘটাতে চায়- দাঙ্গা, আগুন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আর ঠিক সেই সময়ই সক্রিয় হয়েছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায়। ভারতের ছত্রছায়ায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবারও সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস ও অস্থিতিশীলতার মাধ্যমে জাতিকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এরই মধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছে সাবেক মন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, 'জামিনে মুক্তি পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যদি কোনো অপরাধে জড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' তিনি আরও বলেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য সব বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, গণভোট ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াতসহ তাদের সমমনা জোটের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। জামায়াত দাবি করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করতে হবে। অপরদিকে বিএনপি চায়, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক। সরকারও একই দিনে আয়োজনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং আশা করছে, জামায়াত এ বিষয়ে ছাড় দেবে।
তবে বিএনপি জানিয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে গিয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তাবে। সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলোর পক্ষে তখন সেই সিদ্ধান্ত মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
সরকার সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত গণভোট- দুটোই একই দিনে আয়োজনের চিন্তা করা হচ্ছে। সরকারের মতে, দুটি বড় আয়োজন আলাদা দিনে করা প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।
দেশজুড়ে নাশকতা ও নৈরাজ্যের আশঙ্কা থাকলেও নির্বাচন-প্রস্তুতি জোরেশোরে এগিয়ে চলছে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে, তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
সবকিছু মিলিয়ে আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে- আর সাধারণ মানুষ তাকিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ও সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে।
১১৬ বার পড়া হয়েছে