বিএনপি (BNP)র তৃণমূলের শক্তি পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৬:২১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP) কেবল একটি রাজনৈতিক সংগঠন নয়—এটি এক সময় জনগণনির্ভর এক সামাজিক চেতনার নাম ছিল।
রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গঠিত এই দল জন্মলগ্ন থেকেই রাষ্ট্রনির্ভর রাজনীতি নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে। আজ যখন রাজনীতি ক্রমশ কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বলয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, তখন পুনরায় আলোচনায় এসেছে BNP-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি—BNP Grassroot Network (BGN)—অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনভিত্তিক শক্তি ও সামাজিক সংযোগব্যবস্থা।
১. গ্রাসরুট রাজনীতি: ধারণা ও প্রেক্ষাপট-‘Grassroot’ শব্দের অর্থ মাটির কাছের মানুষ—যাঁরা সমাজের মূল ভিত্তি। রাজনীতিতে এটি বোঝায় এমন সাংগঠনিক কাঠামো যেখানে নীতিনির্ধারণ হয় উপরে, কিন্তু শক্তি উৎপন্ন হয় নিচ থেকে। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী Larry Diamond তাঁর গ্রন্থ Developing Democracy (1997)-এ লিখেছেন—Democracy grows not from the palace but from the village.
এই দর্শনই BNP-র রাজনীতির মূল সূত্র। ১৯৮০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়কালে দলটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও গ্রাম পর্যায়ে সক্রিয় সংগঠন গড়ে তোলে—যার ফলেই এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ‘bottom-up political movement’-এ পরিণত হয়।
২. ঐতিহাসিক বিকাশ: জিয়াউর রহমানের জনভিত্তিক রাজনীতি
১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ আদর্শে BNP প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নীতি ছিল—Development must be people-centered, and politics must reach the villages.” (Rahman, 1979)
এই নীতির ফলে গঠিত হয় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের দলীয় কমিটি।
Dhaka University Journal of Political Studies (Amin, 1994) লিখেছে—BNP’s success in the 1991 election was not merely ideological; it was structural, built upon an efficient grassroots communication system.
অর্থাৎ, বিএনপির সাফল্য মূলত এর সংগঠনভিত্তিক তৃণমূল কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ছিল।
৩. BGN-এর কাঠামো: সমাজ ও সংগঠনের সংমিশ্রণ
BNP-র grassroots network পরিচালিত হয় একটি “bottom-up” কাঠামোতে—যেখানে ইউনিয়ন কমিটি, স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন,ছাত্রদল-যুবদল-কৃষকদল ইত্যাদি পরস্পর সংযুক্ত। রাজনৈতিক তাত্ত্বিক Elinor Ostrom (2010) এই ধরনের গঠনকে বলেছেন “polycentric organizational model”—অর্থাৎ, একাধিক কেন্দ্র স্বাধীনভাবে কাজ করলেও একই আদর্শে সংযুক্ত থাকে।
BNP-র ইউনিয়ন সভাপতি বা ওয়ার্ড নেতা সাধারণত শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী—যিনি জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তিনি কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তি নন; এক অর্থে সমাজের “social mediator”।
এই কারণেই বিএনপির তৃণমূল রাজনীতি আন্দোলননির্ভর নয়, বরং সামাজিক সম্পর্কভিত্তিক।
৪. দমননীতি ও তৃণমূল প্রতিরোধ: এক রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা-২০০৯ সালের পর থেকে বিএনপি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক দমননীতির মুখোমুখি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, দলীয় অফিস বন্ধ ইত্যাদি সত্ত্বেও International Crisis Group (2023) জানায়—BNP retains active grassroots cells in nearly 70% of rural unions, despite prolonged political repression. এর পেছনে কারণ হলো, এই নেটওয়ার্ক কোনো ব্যক্তিনির্ভর নয়; এটি এক ধরনের community-based loyalty system—যেখানে পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন রাজনীতির সঙ্গে মিশে গেছে। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে একে বলা হয় “social resilience of political identity”
এই সামাজিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিই বিএনপিকে বারবার পুনর্জীবিত করেছে, এমনকি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায় নিষ্ক্রিয় থাকলেও।
৫. আন্তর্জাতিক তুলনা: Republican, Congress ও Likud মডেল-BNP-র grassroots network তুলনীয় বিশ্বের তিনটি ঐতিহ্যবাহী দলের সঙ্গে—
(ক) Republican Party (USA): রিপাবলিকান পার্টি “County-level Committees” ও “Faith-based networks” এর মাধ্যমে গ্রামীণ ভোটব্যাংক শক্তিশালী রাখে। ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সংযোগ রাখার এই কৌশল BNP-র ইউনিয়ন কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(খ) Indian National Congress: ভারতের কংগ্রেস এক সময় “Panchayat Congress Committees” গঠন করে গ্রামীণ রাজনীতিকে ধারণ করেছিল। BNP-র ইউনিয়নভিত্তিক সংগঠন এই ঐতিহাসিক মডেলেরই আধুনিক রূপ।
(গ) Likud Party (Israel): রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারানোর পর লিকুদ পার্টি স্থানীয় “Community Cells” গঠন করে তৃণমূল থেকে পুনরুত্থান ঘটায়। বিএনপির ক্ষেত্রেও এই একই রকম পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট—যে দল তৃণমূল যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখে, সেই দল দমননীতির মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।
৬.ডিজিটাল যুগে BGN: প্রযুক্তি ও সংগঠনের মেলবন্ধন- ২১ শতকের তৃতীয় দশকে এসে বিএনপি-র তৃণমূল সংগঠন পেয়েছে এক নতুন রূপ—Digital Grassroot Network (DGN)। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা এখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, এমনকি টিকটক ব্যবহার করে তথ্য ও নির্দেশনা ছড়িয়ে দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রায়হান হাবিব ২০২৪ সালে মন্তব্য করেন—BNP’s digital grassroots has partially replaced the physical committees. Information flow and solidarity now depend more on digital networks than offices.
এই বাস্তবতা BNP-র সংগঠনকে দিয়েছে এক hybrid structure—যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিক সম্পর্ক মিলেমিশে তৈরি করছে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো।
৭. রাজনৈতিক শিক্ষা পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় রোডম্যাপ:
BGN-কে শক্তিশালী করতে হলে শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মানবিক শিষ্টাচার মূলক আচরণ, প্রশিক্ষণ ও আদর্শিক শিক্ষা। বর্তমানে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন, গণতন্ত্র, ও নৈতিক নেতৃত্ব বিষয়ে শিক্ষা-অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে।
যদি BNP “Grassroot Leadership Academy” গঠন করে, যেখানে স্থানীয় নেতারা গণতন্ত্র, ইসলামি মূল্যবোধ, মানবাধিকার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন, তবে এটি হবে তৃণমূল নেতৃত্বের মানোন্নয়নের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
শিক্ষাবিদ Paulo Freire ১৯৭০ সালে যথার্থই বলেছেন—Political awakening begins when the oppressed realize they can lead their own communities.
এমন উদ্যোগ BNP-র তৃণমূলকে কেবল রাজনৈতিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিতেও রূপান্তরিত করতে পারে।
৮. আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি: কাঠামোগত পার্থক্য-
আওয়ামী লীগ একটি institutionalized party—যার শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে।
অন্যদিকে, বিএনপি একটি socially embedded party—যার শক্তি জনগণের সঙ্গে নৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে—কাঠামো আওয়ামী লীগ বিএনপি
মডেল-Top-down mobilization, Bottom-up mobilization-বিএনপি’র শক্তির উৎস জনগণ ও সমাজ; এর সংগঠন কাঠামো বিকেন্দ্রীভূত এবং টিকে থাকার ভিত্তি সামাজিক আস্থা। ফলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র দুর্বল হলে বা জনঅসন্তোষ বাড়লে, দলটি দ্রুত মাঠে পুনরুত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়—যেমন দেখা গেছে ২০০৭ ও ২০২৩–২৪ সালের আন্দোলনে।
৯. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের পথ-২০২৫ সালের বাংলাদেশে জনগণ আর কেবল দল নয়, খুঁজছে সুশৃংখল নৈতিক ও মানবিক নেতৃত্ব। এই প্রেক্ষাপটে BNP-র grassroots network হতে পারে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের বাস্তব ভিত্তি।
যদি দলটি BGN-এর মাধ্যমে— তরুণ ও নারী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়, স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে জনগণকে যুক্ত করে এবং রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ করে,
তাহলে এটি “People’s Participatory Model of Democracy”-এর এক কার্যকর রূপ দিতে পারবে।
BNP Grassroot Network (BGN) বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অদৃশ্য কিন্তু বাস্তব শক্তি—যা প্রশাসনিক দমন, নেতৃত্ব সংকট কিংবা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও টিকে আছে। কারণ এটি মানুষের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, এবং নৈতিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেন, “বিএনপি মূলত জনগণনির্ভর একটি রাজনৈতিক কাঠামো। রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি নয়, জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণই এর পুনরুত্থানের মূল ভিত্তি। তাই প্রশাসনিক দমন বা রাজনৈতিক বাধা সত্ত্বেও দলটি প্রতিবার নতুনভাবে সংগঠিত হতে পারে। ২০০৭ কিংবা ২০২৩–২৪ সালের আন্দোলন পর্বে আমরা দেখেছি, জনঅসন্তোষ বাড়লে বিএনপি আবারও মাঠে প্রধান শক্তি হিসেবে ফিরে আসে—যা প্রমাণ করে দলটির সামাজিক শিকড় এখনো গভীরে প্রোথিত।”
BGN প্রমাণ করেছে—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়; এটি জনগণের আস্থা ও সম্পর্কের এক শিল্প। ইউনিয়নের শিক্ষক, বাজারের ব্যবসায়ী, গ্রামের তরুণ কর্মী—এদের হাতেই লুকিয়ে আছে BNP-র গণতান্ত্রিক শিকড়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ যদি কখনো ঘটে, তার বীজ নিহিত থাকবে এই BGN—BNP Grassroot Network-এর মধ্যেই।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞ।
১২৫ বার পড়া হয়েছে