সর্বশেষ

মতামত

ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবকল্যাণে আমার এক অভিযাত্রা

খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী
খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী

রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:১৮ অপরাহ্ন

শেয়ার করুন:
একজন মানুষের শিক্ষা ও কর্মজীবনের যাত্রাপথ অনেকাংশে নির্ধারিত হয় তার পাওয়া সুযোগ, দিকনির্দেশনা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে। আমার জীবনের পথচলায় ব্র্যাক (BRAC) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (BRAC University) একটি মাইলফলকস্বরূপ প্রতিষ্ঠান।

এখানে আমি শুধু কর্মজীবনের হাতেখড়িই পাইনি, বরং পেয়েছি মানবিক মূল্যবোধ, গবেষণার নৈতিকতা এবং বৈশ্বিক মানের শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই প্রবন্ধে আমি আত্মজীবনীমূলক অভিজ্ঞতার আলোকে ব্র্যাকের অবদান, স্যার ফজলে হাসান আবেদের অনন্য নেতৃত্ব, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুপ্রেরণা, এবং শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রগুলোতে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে তথ্য ও গবেষণার আলোকে বিশ্লেষণ করব।

ব্রাকে কর্মজীবনের সূচনা-আমার কর্মজীবন শুরু হয় ২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল, ব্র্যাকে সহকারী গবেষক হিসেবে। এটি শুধু একটি চাকরি ছিল না; বরং ছিল মানবকল্যাণে এক জীবনভর প্রতিশ্রুতির সূচনা। গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমাকে মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে যুক্ত করেছে। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অভাব যে কত ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি করে, তা প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পেরেছি।

ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ শুধু তথ্য সংগ্রহে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সামাজিক নীতি ও উন্নয়ন প্রোগ্রামে সরাসরি প্রভাব ফেলে। গবেষণায় অংশ নিয়ে উপলব্ধি করেছি যে প্রতিটি তথ্যই মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বহন করে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ: মানবিক নেতৃত্বের এক প্রতীক-

ব্র্যাকে কাজ করার সুবাদে আমি স্যার ফজলে হাসান আবেদকে খুব কাছ থেকে দেখার,তার মহাকর্মযজ্ঞ উপলব্ধি করার সৌভাগ্য অর্জন করি। তাঁর বিনয়, নম্রতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ভাষায় বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। তিনি শুধু একজন প্রশাসক ছিলেন না, বরং একজন দিকপাল নেতা যিনি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। এর বিস্তৃতি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ, পুষ্টি, নারী ক্ষমতায়ন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন খাতে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল-

১.মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টি: তিনি সবসময় বলতেন, উন্নয়নের কেন্দ্রে থাকতে হবে মানুষকে।
২.প্রমাণভিত্তিক কর্মসূচি: ব্র্যাক সবসময় মাঠপর্যায়ের তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে কর্মসূচি চালিয়েছে।
৩.আন্তর্জাতিকীকরণ: আফ্রিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত ব্র্যাকের কার্যক্রম ছড়িয়ে গেছে।

 

আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি যে নেতৃত্ব মানে শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, বরং মানুষের ভেতরে আশা জাগানো এবং তাদের সম্ভাবনা বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা। ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল জয় ও অনুপ্রেরণা-২০০৬ সালে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, সেই রাত আমার জন্য ছিল ভিন্ন মাত্রার। আমি ঘুমাতে পারিনি, কারণ মনে হচ্ছিল এটি কেবল একজন মানুষের স্বীকৃতি নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ মডেল দারিদ্র্য বিমোচনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাঁর সাফল্য আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে— দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন শুধু সহানুভূতির বিষয় নয়, বরং এটি হতে পারে গবেষণা, পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনের ভিত্তিতে টেকসই অগ্রগতির অংশ। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও প্রফেসর ড. ইউনূস—দুইজনই আমাকে শিখিয়েছেন যে জীবনকে অর্থবহ করতে হলে কাজ করতে হবে মানুষের কল্যাণে।

শিক্ষা জীবনের উজ্জ্বল পর্ব- আমার শিক্ষাজীবন ছিল এক পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যেসব শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছি, তাঁরা কেবল জ্ঞান বিতরণ করেননি, বরং গবেষণা ও চিন্তার স্বাধীনতা শিখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

 

প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান–অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রফেসর ড. এবিএম সিদ্দিকুর রহমান–উলুমুদ্বীন-আকাইদ, শিক্ষা গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের আধুনিক চিন্তাধারা।
প্রফেসর ড. মোস্তফা কামাল, ড. আবুল কালাম পাটোয়ারী – ইসলামিক ক্রিমিনাল আইন, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান আনোয়ারী, প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী –তুলনামূলক তাফসীর ভিত্তিক জ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর আলোকপাত।
প্রফেসর ড. আফাজউদ্দিন, ড. অলিউল্লাহ, প্রফেসর ড. আবু জাফর খান–প্রয়োগমূলক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষা।

 

এই শিক্ষকদের অবদান আমার গবেষণামুখী মনোভাব গড়ে তুলেছে এবং আমাকে জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও উন্নয়ন নীতি বিষয়ে গভীর চিন্তার সুযোগ দিয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা- ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় আমি যেসব সহকর্মী ও আন্তর্জাতিক গবেষকের সাথে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যেও পেয়েছি একই রকম অনুপ্রেরণা।

 

ড.টিমথি গ্র্যান্ট ইভান্স–গ্লোবাল হেলথের বিশেষজ্ঞ, যিনি স্বাস্থ্যনীতি ও সিস্টেম স্ট্রেন্থেনিং নিয়ে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর সুপারভিশন ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা।
ড.মেকানজি, ড.আকুতো ওসা – আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষক, যাঁদের সাথে কাজ করে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি।
ড.জিয়াউদ্দিন হায়দার, ড. মুশতাক রাজা চৌধুরী – জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশের নেতৃত্বস্থানীয় নাম।
ড.সাদিয়া আফরোজ চৌধুরী, ড. সাবিনা ফয়েজ রশিদ, ড. সাজেদুর রহমান শাওন – ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, যারা আমাকে আন্তঃবিষয়ক ম্যানেজমেন্ট ও গবেষণার সাথে যুক্ত করেছেন।

 

তাঁদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে জ্ঞান ও গবেষণা কেবল একাডেমিক কক্ষেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা মাঠপর্যায়ে মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনে।

 

আমার গবেষণা ও কাজের অভিজ্ঞতা প্রধানত নিম্নোক্ত খাতগুলোতে বিস্তৃত—

 

১.পাবলিক হেলথ (জনস্বাস্থ্য) – ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা মডেল প্রমাণ করেছে কম খরচে কীভাবে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যায়। আমি প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে স্বাস্থ্যকর্মী গ্রামীণ মানুষের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা পৌঁছে দেন।
২.ফুড এন্ড নিউট্রিশন (খাদ্য ও পুষ্টি)–অপুষ্টি বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। ব্র্যাকের উদ্যোগ, যেমন অরাল স্যালাইন, ভিটামিন এ ক্যাম্পেইন, পুষ্টিকর খাবারের প্রচার, এসবের সাথে কাজ করেছি।
৩.হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন)–একটি বৃহৎ এনজিওতে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরি, তা বুঝেছি। কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কর্মী বান্ধব ম্যানেজমেন্ট কিভাবে হতে হয় তার বাস্তব প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা পেয়েছি।
৪.ওয়াটার, স্যানিটেশন এন্ড হাইজিন (WASH) – নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা প্রকল্প দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
৫.ফুড সিকিউরিটি এন্ড নিউট্রিশন সিস্টেম–খাদ্যের প্রাপ্যতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি উদ্ভাবন ও পুষ্টি শিক্ষার সমন্বয় ব্র্যাকের এক বড় অর্জন যার ক্ষুদ্র অংশীদার হতে পারা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যের।
৬.মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ)- মিডওয়াইফারি এবং নার্সিং বিভাগগুলোর একাডেমির সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা আমাকে একাডেমিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে। এ সুযোগে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি আমার জন্য এক গর্বের বিষয়।
৭.এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (শিক্ষা ও গবেষণা)–ব্র্যাকের নন-ফরমাল এডুকেশন মডেল শিক্ষা খাতে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। গবেষক হিসেবে আমি শিক্ষা কর্মসূচির মানোন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করেছি।

 

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানোর সুযোগ পাওয়া। ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শিখিয়েছে—উন্নয়নের মূলে রয়েছে মানবিক মূল্যবোধ।
গবেষণা ও শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, বরং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আমাদের স্থানীয় সমস্যার সমাধানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করে।
আমার জীবনের বাস্তব অর্জন ও অভিজ্ঞতা সবই ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই কর্মজীবন আমাকে শুধু একজন গবেষক বানায়নি, বরং মানবকল্যাণে নিবেদিত একজন কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শন আমাকে সবসময় মনে করিয়ে দেয়—একজন মানুষের সাফল্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা অন্যের জীবনে আলো ছড়ায়। শিক্ষা, গবেষণা ও কর্মক্ষেত্রের এই সমন্বিত অভিজ্ঞতা আমার জীবনের প্রকৃত মূলধন।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘদিনের কর্ম-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।

১৪০ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন