চোর এখনও আছে দেশে, অফিস বন্ধ থাকলেও চুরি বন্ধ হয় না

বৃহস্পতিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:২৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের কার্যক্রম চলতি বছরের মে ও জুন মাসে প্রায় ৪০ দিন বন্ধ ছিল।
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে দলটির নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের জেরে এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে বিস্ময়করভাবে, অফিস কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও জ্বালানি খাতে ব্যয় ছিল পূর্বের মতোই। এতে সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনিয়মের নতুন একটি দৃষ্টান্ত সামনে এসেছে।
ডিএসসিসি’র হিসাব অনুযায়ী, সংস্থাটি প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা জ্বালানির পেছনে খরচ করে। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়—অফিস বন্ধ থাকলেও তেল ব্যবহারে কোনো ভাটা পড়েনি। কাগজে-কলমে অধিকাংশ গাড়ির জন্য প্রতিদিন ১৪-১৫ লিটার তেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যদিও বাস্তবে অনেক গাড়ি চলেইনি।
উদাহরণস্বরূপ, করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকেরের ব্যবহৃত গাড়ি প্রতিদিন ১৫ লিটার করে ৪০ দিনে মোট ৬০০ লিটার তেল গ্রহণ করেছে—যার বাজারমূল্য প্রায় ৬১ হাজার টাকা। অথচ আন্দোলনের সময় তিনি অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ সূত্র। গাড়িচালক কামরুল হাসান স্বীকার করেছেন, ‘প্রতিদিন না, দরকার হলে বের হয়েছি।’
একইভাবে, সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসানও এই সময়ে প্রতিদিন ১৪ লিটার করে ৫৬০ লিটার তেল নিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, সচিবালয়, ওয়াসা ভবন ও কর্মচারী হাসপাতালে কিছু কাজ করতেন, তাই তেল নিয়েছেন। কিন্তু সূত্র বলছে, আন্দোলনের সময় এসব জায়গায় নিয়মিত অফিস পরিচালনার মতো কোনো কাঠামোই ছিল না।
বর্তমানে ডিএসসিসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মোট ৬১০টি গাড়ি রয়েছে। যার মধ্যে ৯১টি গাড়ি ব্যবহারে রয়েছেন কর্মকর্তারা, ১০১টি মোটরসাইকেল এবং বাকি গাড়িগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই তেল বরাদ্দ অনেকাংশেই কাগজে-কলমে দেখানো হয়। কর্মকর্তা ও চালকের মাঝে ‘তেল বিক্রি’ করে অর্থ ভাগাভাগির একটি অবৈধ চক্র সক্রিয় রয়েছে বলেও জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন কর্মকর্তা।
সিটি করপোরেশনের জ্বালানি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ চৌধুরী জানিয়েছেন, আন্দোলনের সময় তিনি ব্যস্ত থাকায় তেল ইস্যুর দায়িত্ব অন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক পালন করেছেন। তবে চূড়ান্ত বিলে তিনি স্বাক্ষর করেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—তথ্য যাচাই না করে কেন তেল ইস্যু করা হলো?
বাস টার্মিনালের তত্ত্বাবধায়ক মামুন উদ্দিন দাবি করেছেন, ‘করপোরেশন বন্ধ থাকলেও বেশিরভাগ কর্মকর্তা অফিস করেছেন’। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই বলে মত দিয়েছেন করপোরেশনের অনেকেই।
ডিএসসিসি প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া জুন মাসে তাঁর জন্য বরাদ্দ পাওয়া গাড়িতে ৮৫৫ লিটার তেল ব্যবহার করেছেন বলে নথিতে দেখা গেছে। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, সবসময় সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করেন না।
চালক শাহ আলম জানান, অফিসের কাজেই গাড়ি চালানো হয়েছে। তবে তেল বিক্রি করে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভাগাভাগির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জনগণের অর্থের যোগসাজশপূর্ণ আত্মসাতের এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যারা সরাসরি লাভবান হয়েছেন এবং যারা এ প্রক্রিয়াকে অনুমোদন দিয়েছেন—কেউই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের ঘটনা সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবেরই প্রতিচ্ছবি, যা দুর্নীতিকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।”
২৪৩ বার পড়া হয়েছে