মেঘনা নদীর ঢেউয়ে হারিয়ে গেল আরেকটি সত্য - বিভুরঞ্জনের বিদায়

শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫ ৬:২৬ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
মেঘনা নদী যেন সাক্ষী থাকল বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আরেকটি কালো দিনের।
২২ আগস্ট, ২০২৫—সকাল হতে না হতেই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার কলাগাছিয়ায় নদীর জলে ভেসে উঠল একটি নিথর দেহ। কেউ জানত না, এই দেহটিই সেই বিভুরঞ্জন সরকারের—যিনি কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সত্য লিখে নিজের অস্তিত্বকে উৎসর্গ করেছিলেন।
নিখোঁজ থেকে নদীর জলে
২১ আগস্ট সকাল দশটায় ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় বিদায় জানিয়ে তিনি অফিসের পথে পা বাড়ান। পরিবারের কাছে শেষ কথা ছিল, ‘আজ একটু দেরি হতে পারে।’ এরপরই তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। পরিবার ও সহকর্মীদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে, নিখোঁজ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সাংবাদিক সমাজে। রমনা থানায় করা হয় সাধারণ ডায়েরি।
নদীর জলে পাওয়া
পরের দিন, বিকেলে—মেঘনা নদীর ঢেউয়ে ভাসছিল একটি অজ্ঞাত দেহ। নৌ পুলিশ উদ্ধার করে। জেনারেল হাসপাতাল মর্গে তখন পরিবারের বুক ফাটা কান্না, ছেলের আকাশভাঙা শোক। মুখাবয়ব, হাতের আংটি, শার্ট—সব মিলিয়ে নিশ্চিত হল বিভুরঞ্জনের ‘শেষ ঠিকানা’।
বিভুরঞ্জনের কলম: মৃত্যুর আগের শেষ বার্তা
মৃত্যুর ঠিক আগের দিন বিডি নিউজে পাঠানো চিঠিতে বিভুরঞ্জনের আক্ষেপ—“এটা জীবনের শেষ লেখা হিসেবে ছাপতে পারেন।” দীর্ঘ জীবনের সাংবাদিকতার কষ্টগাঁথা ফুটে উঠেছে ওই চিঠিতে। তিনি লিখেছেন— “এই দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। কিন্তু আজ, যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি—সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।”
তাঁর কলম থেমে গেছে, কিন্তু সত্যের লড়াই শেষ হয়নি।
সত্য লেখার ঝুঁকি
বিভুরঞ্জন সরকার ছিলেন আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও খ্যাতিমান কলাম লেখক। তিনি কখনো আপোষ করেননি—হুমকি উপেক্ষা করে, রাতের অন্ধকারে শহর ঘুরে খুঁজে এনেছেন সত্যের গল্প।
পেশার ঝুঁকির কথাও লিখতেন তিনি— “সত্য কোনো অবিচারের সামনে মাথা নত করে না, কিন্তু তার বিনিময়ে সাংবাদিককে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়।”
পুলিশি তদন্ত ও সাংবাদিক সমাজের প্রতিবাদ
মৃত্যুর কারণ তদন্তাধীন—হত্যা, আত্মহত্যা না দুর্ঘটনা, সে বিষয় এখনও নিশ্চিত নয়। তবে সাংবাদিক সমাজে গর্জে উঠেছে শোক, অনেকে বলছেন—‘সত্য লিখে দেশবদল করি, কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেন আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াই’।
সাংবাদিকতার প্রতীক বিভুরঞ্জন—আমাদের দায়
মেঘনার জলে হারানো বিভুরঞ্জন শুধু একজন মানুষ নন, সত্যবাদের প্রতীক। তাঁর বিদায় সাংবাদিক সমাজ, পাঠক এবং গণতন্ত্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আজ সবাই ভেবে দেখছে—এই দেশে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সত্য বলা!
বিভুরঞ্জনের চিঠির শেষ বাক্য মনে করিয়ে দেয়— “সত্য লিখলে বেঁচে থাকা যায় না—এটাই আজ প্রমাণিত।”
বাংলাদেশে সত্যের লড়াই চলুক বিভুরঞ্জনের স্মৃতিকে শক্তি করে।
তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সাংবাদিকতা জগতের পক্ষ থেকে নত শিরে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মেঘনার ঢেউয়ে হারিয়ে যাওয়া বিভুরঞ্জন সরকার আমাদের কাছে আজীবন অনুপ্রেরণার মশাল।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১১৮ বার পড়া হয়েছে