সর্বশেষ

জাতীয়

নিউটাউন সোসাইটির নির্বাচন: গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার মাইলফলক

স্টাফ রিপোর্টার
স্টাফ রিপোর্টার

সোমবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৫ ৮:১৬ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
গণতন্ত্র তখনই প্রকৃত অর্থে অর্থবহ হয়ে ওঠে, যখন জনগণ নির্ভয়ে, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পান। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমননীতি ও স্বৈরাচারী শাসনের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ বারবার এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে, যখন সাধারণ মানুষ তাদের এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

তবে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নিউ টাউন সোসাইটির প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন যেন সেই অন্ধকার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল আলোকরেখা। প্রায় দুই হাজার ভোটারের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সুষ্ঠু ব্যালট প্রক্রিয়া এবং ভোট-পরবর্তী সন্তুষ্টি স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

রাজধানী ঢাকার নিউটাউন সোসাইটির জন্ম হয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার এক ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে। এটি সম্পূর্ণ একটি অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় শাসনে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। চার দিন ধরে দেশ কার্যত প্রশাসনশূন্য অবস্থায় পড়ে যায়, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সহিংসতায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে নিউ টাউন এলাকার কয়েকজন সচেতন মানুষ—ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা মো: মোতাছিম বিল্লাহ ও মো: আবু জাফর, দৈনিক কালের কথার সম্পাদক খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী এবং ইসলামী ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা মো: জসিম উদ্দিন সিকদার—৭ আগস্ট রাতে বসে পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই বৈঠকেই “নিউটাউন সোসাইটি” প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। মূল লক্ষ্য ছিল একটি স্বচ্ছ, অরাজনৈতিক এবং জনকল্যাণমূলক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, যা স্থানীয় জনগণকে রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্ত করে একটি সমন্বিত সামাজিক কাঠামো তৈরি করবে।

২০২৫ সালের ১ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন ছিল সোসাইটির প্রথম বৃহৎ গণতান্ত্রিক আয়োজন। প্রায় দুই হাজার ভোটারের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে যে স্থানীয় জনগণ কতটা সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন। ব্যালটভিত্তিক ভোটগ্রহণে ভোটাররা নিজেদের মতামত নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পেরেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নেছার উদ্দিন আহাম্মদ এবং কমিশনার হিসেবে মো: জালাল আহাম্মদ হাওলাদার, মো: মোতাছিম বিল্লাহ, অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান ও সচিব মো: আবু জাফরের নেতৃত্বে নির্বাচনটি পরিচালিত হয়। পরিচালনা কমিটিতে খাজা মাসুম বিল্লাহ কাওছারী, ডা. দেলোয়ার জাহান ইমরান ও মো: জসিম উদ্দিন সিকদারের মতো সদস্যদের সততা ও নিষ্ঠা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে ভূমিকা রাখে।

এই নির্বাচনে কোনো সহিংসতা, প্রভাব খাটানো বা প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেনি। ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনী পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের উপস্থিতি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। ফলে নিউ টাউন সোসাইটির নির্বাচন প্রমাণ করেছে—যদি নিরপেক্ষ কমিশন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাঠামো থাকে, তবে জনগণ নিজেরাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায়ই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে ভোট কারচুপি, প্রশাসনিক পক্ষপাত কিংবা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের কারণে। এই প্রেক্ষাপটে নিউ টাউন সোসাইটির নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ে একটি আদর্শ মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ভোটাররা প্রার্থীর যোগ্যতা, সততা ও নেতৃত্বের দক্ষতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কেবল প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করেননি। সোসাইটির অরাজনৈতিক কাঠামো প্রমাণ করেছে যে সামাজিক উন্নয়ন ও সুশাসনের জন্য রাজনৈতিক পতাকার প্রয়োজন নেই। দীর্ঘ সময় ভীতি ও সন্ত্রাসে বসবাস করা মানুষ এ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন।

ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩৪০ জন রোড প্রতিনিধি আগামী তিন বছর জনগণের সেবা করবেন। তাদের সামনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, মাদক ও সন্ত্রাস দমন করে তরুণ সমাজকে রক্ষা করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, চাঁদাবাজি নির্মূলের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। একই সঙ্গে ড্রেনেজ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় ভিন্নমতকে সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করাও হবে তাদের বড় দায়িত্ব। তাদের সততা ও কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করবে, এই নির্বাচন প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক সাফল্যে রূপ নেবে নাকি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকবে।


নিউ টাউন সোসাইটির নির্বাচন জাতীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়ের জন্যই একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। জনগণ যদি আস্থা পায়, তবে তারা গণতন্ত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত। এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে সমবায় প্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা নির্বাচনের জন্যও একটি অনুকরণীয় রোল মডেল হতে পারে।

সবশেষে এ নির্বাচন মনে করিয়ে দিয়েছে যে গণতন্ত্র কোনো শাসকগোষ্ঠীর দান নয়; এটি জনগণের অধিকার। জনগণ চাইলে এবং সঠিক কাঠামো গড়ে উঠলে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা ও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। নিউ টাউন সোসাইটির প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন তাই শুধু ভোটগ্রহণ নয়, এটি ছিল স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের আস্থার প্রতিফলন। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দমননীতির পর এ নির্বাচন প্রমাণ করেছে—জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সক্ষম। এখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব হবে কথার চেয়ে কাজে প্রমাণ করা। তারা যদি সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করেন, তবে নিউ টাউন সোসাইটি কেবল একটি আবাসিক সংগঠন নয়, বরং দেশের জন্য একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

১২৩ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
জাতীয় নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন