বিচারহীনতার দেশে ধর্ষকই নিরাপদ!

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫ ৭:২৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশে ধর্ষণ এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি ব্যর্থতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং নারী নিরাপত্তার চূড়ান্ত সংকটের প্রতিচ্ছবি।
বারবার ধর্ষণের ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই দেশে নারী কোথাও নিরাপদ নয়। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক সত্যটি হলো: অপরাধী বেঁচে যায়, অথচ ভুক্তভোগী কিংবা সমাজ বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়।
আমরা চিৎকার করে বলি, ‘ধর্ষকের ফাঁসি চাই’, কিন্তু রাষ্ট্র বলে, ‘সময় লাগবে।’ আমরা প্রতিবাদ করি, কিন্তু বিচার আসে না। কারণ, এই দেশে বিচারহীনতা যেন অপরাধীদের জন্মগত অধিকার।
জাহাঙ্গীরনগরের কালিমালিপ্ত ইতিহাস- ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বনামধন্য ছাত্র সংগঠনের নেতা জসিমউদ্দিন মানিক প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি একজন তরুণীকে ‘একশোবার’ ধর্ষণ করেছেন। উদযাপনে বিতরণ করেছিলেন মিষ্টি।
দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, ১৯৯৯ সালের ২ আগস্ট ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে মানিক ও তার সহযোগীরা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, আজও সেই ঘটনায় কোনো মামলার রায় হয়নি, কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি হয়নি।
এটি আমাদের বিচারব্যবস্থার একটি দুঃখজনক উদাহরণ, যেখানে অপরাধী প্রকাশ্যে গর্ব করে অপরাধের কথা বলেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর বিচার থমকে থাকে অস্পষ্টতায়।
খাদিজার রক্তাক্ত মুখ, কিন্তু নীরব রাষ্ট্র- ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার নিগারকে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেন সিলেট ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হয়। তীব্র গণপ্রতিক্রিয়ার পরেও বিচার বিলম্বিত হয়। খাদিজা প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু একজন ছাত্রীর উপর প্রকাশ্যে কুড়াল দিয়ে হামলার বিচার যদি দ্রুত না হয়, তবে কোন মাপকাঠিতে আমরা নারী নিরাপত্তার কথা বলি?
বরিশালে মা-মেয়ের ওপর বর্বরতা- ২০১৮ সালে বরিশালের বানারিপাড়ায় ‘তুফান’ নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলেও, ঘটনাটি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। আজ পর্যন্ত সেই মামলার কোন স্পষ্ট তথ্য বা অগ্রগতি জনসম্মুখে আসেনি। এই ধরনের ঘটনাগুলোর তদন্তের ধীর গতি ও অপরাধীর ক্ষমতাধর পরিচয়ই প্রমাণ করে—ধর্ষক জানে, সে পার পেয়ে যাবে।
তনু হত্যা—নিরাপত্তার প্রতীক ক্যান্টনমেন্টেও নিরাপত্তা নেই-
২০১৬ সালের কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। তিনবার ময়নাতদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ মিললেও, আজও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, "তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো জেনেও অপরাধীকে আড়াল করছে।"
এটি একটি ভয়াবহ বার্তা দেয়—বাংলাদেশে এমনকি সেনানিবাসেও নারী নিরাপদ নয়!
সুবর্ণচরে দলবদ্ধ ধর্ষণ—রাজনীতির ছায়া-
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর, নির্বাচনের পরদিন নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক প্রতিপক্ষ দলের নারীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা রুহুল আমিন ও তার অনুসারীরা।
গণমাধ্যমে শোরগোল হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। বরং মামলার গতি থেমে যায় রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়ায়।
শিশুদের ওপর পাশবিকতা ও জাতির লজ্জা- সম্প্রতি ঢাকায় একটি ৭ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। আবার এক ঘটনায়, মাত্র ৩ বছর বয়সী শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়।
এই অপরাধগুলো এতটাই নির্মম যে, ভাষা হারিয়ে যায় বর্ণনা করতে। গ্রেফতার হলেও বিচারের গতি এত ধীর যে মনে হয়, আমরা কেবল অপরাধীদের সময় দিচ্ছি আত্মরক্ষার কৌশল খুঁজে নিতে। আমাদের দেশে ধর্ষণের জন্য আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। মামলা হয়, তদন্ত শুরু হয়, কিন্তু বিচার হয় না, আর হলেও হয় দীর্ঘসূত্রতা আর আপসের রূপরেখায়।
২০২৩ সালে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে” ধর্ষণের মোট মামলা হয়েছে ৫,১৯১টি,
২০২৪ সালে একই আইনে রেকর্ডকৃত ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৪,৩৯৪টি। ২০২৩–২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ মাসে মোট ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৯,৯৭৭টি, অর্থাৎ গড়ে দিনে প্রায় ১৩ জন ভুক্তভোগী। শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেই মামলার সংখ্যা বেড়ে ৩৯২টি, যা গত ২ বছরের একই মাসের তুলনায় বেশি।
গত ১০ বছর (২০১৫–২০২৫) পরিসংখ্যান এর দিকে তাকালে দেখা যায়- এই দশকে ধর্ষণের মোট মামলা হয়েছে ২৭,৪৭৯টি, এর মধ্যে ২০২০–২০২৩ মধ্যে ৬৩২ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন মাত্র ১৫৩ দিনে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী- ২০১৭–২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ৯,৬৭৭ জন শিশু নির্যাতনভুক্ত ৪,৮০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
একই সময়ে ধর্ষণের পর হত্যা: ২৪০ জন শিশু যাদের ৬ বছর থেকে ১২ বছরের মধ্যে রয়েছে বেশিরভাগ। ২০২৫ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে HRSS এর গবেষণা তথ্য অনুযায়ী সহিংসতার ২২৪ ঘটনায় ১০৭ ধর্ষণ (৬৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক) এবং ২৭টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক গড়ে ১২টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে।
মাগুরায় ৮ বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণ ও মৃত্যুর প্রতিবাদে সমগ্র দেশে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সমাবেশ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবী ওঠে। অন্য এক তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণ মামলার ৯৮.৬৪% আসামী খালাস পান, মাত্র ১.৩৬% দণ্ডিত হন।
২০১৫–১৮ সালে ৪,৩৭২ মামলা থেকে শুধুমাত্র ৫ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছিল।
২০২৩–২৪ এ প্রায় ৪–৫ হাজার মামলা এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি আবারও উপরের দিকেই ধাবিত হচ্ছে।
শিশু ধর্ষণের হার উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বেড়েই চলছে। হাজারের অধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে—বিশেষ করে ২০১৭–২৫ সময়ে প্রায় ৪,৮০০ শিশু । বিচারহীনতা ভারী এমন মামলাগুলোর প্রায় ৯৯% আসামী মামলা থেকে খালাস পাচ্ছেন।
বিচারহীনতার এই সংস্কৃতির পেছনে দায়ী রাজনৈতিক প্রভাব, তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি, সাক্ষীর নিরাপত্তার অভাব, দুর্বল চার্জশিট, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক চাপে নির্যাতিতার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় কোথায় আমরা?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের শাস্তি খুবই কঠোর:
চীন মেডিকেল প্রমাণ সাপেক্ষে ট্রায়াল ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড।
রাশিয়া ধর্ষককে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
যুক্তরাষ্ট্র বয়স ও ধর্ষণের ধরন বিবেচনায় ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। মধ্যপ্রাচ্য জনসম্মুখে পাথর নিক্ষেপ, যৌনাঙ্গ কর্তন, ফাঁসি।
পোল্যান্ড ধর্ষককে বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে মৃত্যুদণ্ড।
বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তির সর্বোচ্চ সীমা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন থাকলেও কার্যকরতা দুর্বল। অপরাধীরা জানে—দণ্ডের ভয় নেই, বিচার নেই, ফলে তারা আরও বেশি বেপরোয়া।
আমাদের করণীয় কী?
আমরা চাই— দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল চালু হোক, যেখানে প্রতিটি ধর্ষণের বিচার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হবে।
জনসম্মুখে ফাঁসি নয়, জনসম্মুখে রায় ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা, যাতে মানুষ দেখে—ধর্ষণের শাস্তি হয়। সাক্ষীর নিরাপত্তা, ভুক্তভোগীর মানসিক সহায়তা ও পুনর্বাসন, এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত তদন্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হোক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘Consent Education’ বাধ্যতামূলক করা হোক। ধর্ষণের মামলায় পুলিশ ও চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক।
আমরা আর বিচারহীনতা দেখতে চাই না। আমরা আর শুনতে চাই না, ‘ধর্ষকের বিচার হবে’, অথচ বছর পেরিয়ে যায়, রায় আসে না।
আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে একজন ধর্ষক জানবে—এই অপরাধ করলে সে বাঁচবে না।
নারীর চোখে যেন ফিরে আসে আত্মবিশ্বাস, সাহস, মর্যাদা।
এখন সময়— শুধু আইন নয়, তার বাস্তব প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার।
আর না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুখ ফুটে বলবে,
"ধর্ষকেরা বাঁচে, আমরা মরতে থাকি!"
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালের কথা
১৬১ বার পড়া হয়েছে