নির্বাচিত সরকার ও তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা
মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ইশতেহার বা প্রতিশ্রুতি জনগণের সামনে তুলে ধরছে।
বিএনপি তাদের ইশতেহারে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও দুর্নীতি প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবারের নির্বাচনে কর্মসংস্থানের বিষয়টি একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, কাজের ইচ্ছা ও প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও যারা গত সাত দিনে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ পায়নি, তাদের বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। বেকারত্ব একটি গুরুতর অর্থনৈতিক ব্যাধি, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বেকারত্বের ফলে জিডিপি ও ভোক্তা ব্যয় হ্রাস পায়, বিনিয়োগে মন্দা দেখা দেয়। একই সঙ্গে সমাজে অপরাধ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। মানবসম্পদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মানুষের আয় কমে গিয়ে জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায়, যা ব্যবসা ও শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে স্থবিরতা সৃষ্টি করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭.৫৭ কোটির বেশি, যার মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৭১ লক্ষ। দেশে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ হলেও বাস্তবে এই হার আরও বেশি, বিশেষ করে যুব ও উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। বিবিএস-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লক্ষ। ফলে বাংলাদেশে বেকারত্বের সমস্যা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। প্রতিবছর প্রায় ২০ লক্ষ নতুন কর্মজীবী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
এ ছাড়া শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তাদের দক্ষতা শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত মুখস্থনির্ভর; এখানে ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমবাজার উপযোগী সফট স্কিল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় না। উদ্যোক্তাদের মতে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি চাকরির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়, ফলে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ ৫০ হাজার ৬৮৩ জন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তার শেষ কর্মদিবসে রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রকৃত মেধাবীরা মেধার ভিত্তিতে চাকরি না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি বড় অশনিসংকেত।
টেকসই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সফট স্কিল ও দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রায়োগিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা মেধাবীদের আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শিল্পখাতের সঠিক বিকাশ এবং সহায়ক শিল্পনীতি প্রণয়ন জরুরি। গ্রামীণ ও তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের আন্দোলনে দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। জুলাই-২৪ পরবর্তী সময়ে দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লক্ষ। কর্মক্ষম ও দক্ষ ভোটাররা সম্মানজনক ও অধিক আয়ের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা চান। তারা দারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নত জীবনমানের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশা করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তরুণদের এই আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
তবে বাস্তবতা হলো, নির্বাচিত হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রতি উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। নির্বাচিত সরকারের প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং চাকরি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মক্ষম তরুণ জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের মূল্যবান মানবসম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে এবং দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটবে।
তবে নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার, আদর্শ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে প্রার্থী নির্বাচন করবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
১৪৬ বার পড়া হয়েছে