জোট রাজনীতিতে ঝড়: জামায়াত ইস্যুতে ভাঙনের মুখে এনসিপি
রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৯:৫৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
জামায়াতের কোলে এনসিপি, পদত্যাগের হিড়িক, নারী নেত্রীদের অনিহা আর বিএনপির সঙ্গে গোপন যোগাযোগ—সব মিলিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’ (এনসিপি) এখন এক গভীর অস্থিরতার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
জুলাইয়ের ছাত্র–যুব অভ্যুত্থানের পর উদীয়মান বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এই দলটি ক্ষমতার সমীকরণে টিকে থাকার কৌশল খুঁজতে গিয়ে আদর্শগত সঙ্কটে জড়িয়ে পড়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে আসন–বিনিময় ও জোট আলোচনা ঘিরে এনসিপির ভেতরে যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে, তা এখন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। দলটির একাংশ মনে করে, এককভাবে নির্বাচনে টিকে থাকা এনসিপির পক্ষে প্রায় অসম্ভব; ফলে জামায়াত–নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সমঝোতা করলে অন্তত কিছু আসনে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে। অন্যদিকে বিরোধী শিবিরের শক্তিশালী মেরু বিএনপির সঙ্গেও একটি অংশ যোগাযোগ রাখছে, যাতে দর–কষাকষির টেবিলে নিজেদের গুরুত্ব তুলে ধরা যায়।
এই প্রক্রিয়াকে ঘিরেই এনসিপির কেন্দ্রীয় ও মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে নীতিগত মতপার্থক্য, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে আগের জনমত, এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে এনসিপির ঘোষিত অবস্থানের কথা তুলে কিছু নেতা প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলছেন—‘জুলাই আন্দোলনের নামে গড়া দল কি শেষ পর্যন্ত আরেকটি জামায়াত–ঘনিষ্ঠ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হচ্ছে?’ সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে বেশ কিছু নেতা পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অনেকেই সম্মিলিত পদত্যাগের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যা দলটির সাংগঠনিক ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে তুলেছে।
সবচেয়ে দৃশ্যমান বিরোধিতা এসেছে নারী নেত্রী ও তরুণী সংগঠকদের কাছ থেকে। তাদের অভিযোগ, জামায়াত ও তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলো অতীতে বারবার নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে সীমিত করার চেষ্টা করেছে, অনলাইন ও অফলাইনে নারী রাজনীতিকদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালিয়েছে। তাই এমন একটি শক্তির সঙ্গে জোট মানে এনসিপির নারী কর্মীদের জন্য বাস্তবিক অর্থেই পিছিয়ে পড়া, নিরাপত্তাহীনতা ও সাংগঠনিক অপমান—এই বার্তাই তারা নেতৃত্বের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। অনেক নারী নেতা মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে এনসিপি আর কোনোভাবেই নিজেকে স্বাধীন, প্রগতিশীল ও নারী–বান্ধব শক্তি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারবে না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির একটি বড় অংশের যোগাযোগ নতুন রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করেছে। একদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতকে ‘অস্বস্তিকর সহযোগী’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে মাঠের বাস্তবতায় তাদের অনেক আসনে জামায়াতের ভোট ও সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর নির্ভরতা অস্বীকার করা কঠিন। এনসিপি যদি জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য সমঝোতায় যায়, তবে বিএনপির জন্যও বিরোধী জোটের নৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়বে; আবার এনসিপিকে পুরোপুরি দূরে ঠেলে দিলে তরুণ ভোট এবং জুলাই–উদ্ভূত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেদের আলাদা হওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির বর্তমান সঙ্কট কেবল একটি ছোট দলের কৌশলগত টানাপোড়েন নয়; এটি ভবিষ্যৎ বিরোধী রাজনীতির চরিত্র, জোট–সমীকরণ এবং জুলাই আন্দোলন–উদ্ভূত ‘নতুন রাজনীতি’র বিশ্বাসযোগ্যতারও পরীক্ষা। জামায়াতের কোলে ভর করলে এনসিপি হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কিছু আসন বা আলোচনার টেবিলে জায়গা পাবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও নৈতিক অবস্থান প্রশ্নের মুখে পড়বে—এই আশঙ্কাই এখন দলটির ভেতরে ও বাইরে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২৪ বার পড়া হয়েছে