কঙ্গো থেকে আবিয়েই: বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের রক্তাক্ত ইতিহাসে নতুন অধ্যায়
রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:০৮ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
সুদানের আবিয়েই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় ৬ বাংলাদেশি সেনা শান্তিরক্ষীর মৃত্যু ও অন্তত ৮ জনের আহত হওয়া বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা ইতিহাসে আরেকটি রক্তাক্ত মাইলফলক হয়ে উঠেছে।
এই হামলা শুধু চলমান সুদানি গৃহযুদ্ধের অস্থির বাস্তবতাকেই নতুন করে সামনে আনেনি, স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এর আগে কঙ্গোর জঙ্গলে ও বেনিনের আকাশে ঝরে পড়া বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের রক্তের কথা।
আবিয়েই হচ্ছে সুদান-দক্ষিণ সুদানের সীমান্তবর্তী তেলসমৃদ্ধ ও দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ এলাকা, যেখানে জাতিসংঘের UNISFA মিশনের অধীনে বহু বছর ধরে শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালন করছেন। সাম্প্রতিক ড্রোন হামলাটি ছিল লক্ষ্যভিত্তিক ও প্রযুক্তিনির্ভর; উড়োজাহাজবিহীন ড্রোন থেকে বিস্ফোরক নিক্ষেপ করে সরাসরি জাতিসংঘ ঘাঁটির ওপর আঘাত হানা হয়, একই সঙ্গে স্থলভাগ থেকেও সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা হয় বলে প্রাথমিক বর্ণনায় উঠে এসেছে। এতে বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টের ৬ জন সদস্য প্রাণ হারান, আহত হন আরও ৮জন ; তাদের মধ্যে কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের জন্য এটি হঠাৎ নেমে আসা প্রথম বিপর্যয় নয়। ২০০৫ সালে কঙ্গোর ইটুরি অঞ্চলে মিলিশিয়াদের অতর্কিত হামলায় একসঙ্গে ৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছিলেন; নীল হেলমেট পরা সেই তরুণদের মৃত্যু বিশ্বজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। কঙ্গোর সেই অপারেশন ছিল ক্লাসিক ‘অ্যামবুশ’—শত্রু শক্তি গোপনে অবস্থান নিয়ে টহলরত শান্তিরক্ষীদের ওপর টার্গেটেড গুলি ও ভারি অস্ত্রের আঘাত হেনেছিল। কঙ্গোর জঙ্গল থেকে সুদানের আবিয়েই পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, শান্তিরক্ষীরা অনেক সময় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর জন্য কৌশলগত প্রতিবন্ধকতাতেই পরিণত হন।
তারও আগে ২০০৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বেনিনের কোটোনু বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হয় UTA ফ্লাইট ১৪১—যাত্রায় ছিলেন সিয়েরা লিওনের UNAMSIL ও লাইবেরিয়ার UNMIL মিশনে দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফেরা বাংলাদেশি সেনা সদস্যরা। সেই দুর্ঘটনায় মোট ১৫ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রাণ হারান; দুর্ঘটনাটি ইতিহাসে ‘বেনিন ট্র্যাজেডি’ নামে স্থায়ী হয়ে গেছে। বিমানটির অতিরিক্ত বোঝাই, ভারসাম্যহীনতা ও রানওয়ের সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে যে বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল, তা এক ঝটকায় ১৫টি বাংলাদেশি পরিবারকে শোকের সাগরে ডুবিয়ে দেয় এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় স্তরে তীব্র বেদনার আবহ তৈরি করে।
এই তিনটি ঘটনা—বেনিনের বিমান দুর্ঘটনা, কঙ্গোর ইটুরি অঞ্চলে অতর্কিত হামলা এবং সর্বশেষ সুদানের আবিয়েইতে ড্রোন আক্রমণ—একটি সুতোয় গাঁথা বলেই মনে হয়। তিন ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ছিলেন আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটের অধীনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সংঘাতশান্তির দায়িত্বে নিয়োজিত; কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের অস্থির বাস্তবতা, দুর্বল অবকাঠামো ও ক্রমবিবর্তিত যুদ্ধপ্রযুক্তি তাঁদেরকে নিজেরাই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। অতীতে যেখানে সড়ক টহল বা স্থলঘাঁটির ওপর গুলি–বোমা হামলাই বড় ঝুঁকি ছিল, এখন সেখানে যুক্ত হয়েছে ড্রোন, নির্দেশিত গোলাবারুদ ও দূরপাল্লার আক্রমণের নতুন হুমকি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের অন্যতম বৃহৎ শান্তিরক্ষী–প্রেরণকারী দেশ; কোটিকোটি ডলারের রেমিট্যান্স, আন্তর্জাতিক সুনাম ও কূটনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন এক মানবিক মূল্য, যার নাম শহীদ শান্তিরক্ষী। কঙ্গো থেকে আবিয়েই পর্যন্ত রক্তাক্ত এই ইতিহাস নতুন করে প্রশ্ন তুলছে—শান্তির দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীকে রক্ষায় জাতিসংঘ ও অংশগ্রহণকারী দেশগুলো কতটা প্রস্তুত, এবং নতুন প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের যুগে নীল হেলমেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী ধরনের কৌশলগত পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। সুদানের আবিয়েইয়ের সাম্প্রতিক হামলা তাই শুধু একটি বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; বরং বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাসে আরেকটি করুণ, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৩০ বার পড়া হয়েছে