তাজমহল নিয়ে নতুন বিতর্কে বলিউড, ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তীব্র
মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪:১৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
ভারতের প্রেমের প্রতীক তাজমহলকে ঘিরে ফের উত্তাপ ছড়িয়েছে বলিউডের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘দ্য তাজ স্টোরি’। গত অক্টোবর মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমা ঐতিহাসিক স্থাপনাটির পেছনের ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় সমালোচনার মুখে পড়েছে।
চলচ্চিত্রটিতে বিষ্ণু দাস নামে এক ভ্রমণ গাইডের গল্প দেখানো হয়েছে, যিনি দাবি করেন তাজমহল কোনো মুসলিম সমাধি নয়, বরঞ্চ এটি ‘হিন্দু প্রাসাদ’-যা পরবর্তীতে ইসলামি শাসকেরা দখল করে পরিবর্তন করেছিলেন। ইতিহাসবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে যেসব প্রমাণ তুলে ধরে এসব দাবি অস্বীকার করেছেন, সিনেমাটি সেই বিতর্কিত তত্ত্বকেই সামনে এনেছে।
বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকের মতে, ‘দ্য তাজ স্টোরি’ ইচ্ছাকৃতভাবে তাজমহলের ইসলামি ঐতিহ্যকে খাটো করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বয়ানকে জোরদার করছে। তাঁদের অভিযোগ, এ ধরনের সিনেমা ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে সমর্থন করে এবং মুসলিম ইতিহাসকে অবমূল্যায়নের ধারাবাহিক প্রয়াসের অংশ।
পরিচালক তুষার গোয়েল অবশ্য দাবি করেছেন, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের অর্থায়ন ছাড়াই সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে।
চলচ্চিত্রে মূল চরিত্রে অভিনয় করা পরেশ রাওয়াল একসময় বিজেপির সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনিও দাবি করেছেন, সিনেমাটি ধর্ম নয়, কেবল “তথ্যের অনুসন্ধান” তুলে ধরেছে।
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (এএসআই) বহুবার বলেছে—তাজমহল নির্মাণের ইতিহাস স্পষ্টভাবে নথিভুক্ত। শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিতে ১৭ শতকে এই সাদা মার্বেলের সমাধি নির্মাণ করেছিলেন-এ সত্য নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সিনেমাটিকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সংকলন’ বলেছে। দ্য উইক–এর পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এটি “না শিল্পমান বজায় রাখতে পেরেছে, না কার্যকর প্রোপাগান্ডা হতে পেরেছে।”
সমালোচকেরা বলছেন, গত এক দশকে বলিউডের বড় অংশ রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকেছে। আগে যে শিল্প ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বহন করত, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ বা ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র মতো বিতর্কিত বয়ান। এসব সিনেমাকে ইতিহাস বিকৃতি ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছে।
২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের এক পর্যটন পুস্তিকায় তাজমহলের নাম বাদ পড়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ২০২২ সালে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা তাজমহলের ২২টি সিল করা কক্ষ খুলে “হিন্দু মন্দিরের প্রমাণ” খোঁজার আবেদন জানান। এসব দাবির ভিত্তি ছিল ডানপন্থী লেখক পি. এন. ওকের বহু আগে খণ্ডিত ‘তেজো মহালয়া’ তত্ত্ব।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এসব দাবি প্রমাণহীন। মোগল আমলের আমলাতান্ত্রিক নথিপত্রে তাজমহল নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়া বিশদভাবে আছে-যা বিকল্প তত্ত্বের কোনো জায়গাই রাখে না।
‘দ্য তাজ স্টোরি’র প্রচারণা পোস্টারগুলোতেও হিন্দুত্ববাদী প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু পোস্টারে দেখা যায়, তাজমহলের অভ্যন্তর থেকে শিবের প্রতীক উদ্ভাসিত হচ্ছে-যা নিয়ে আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
সিনেমায় মুসলিম চরিত্রগুলোকে প্রায়ই বিরোধী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে-যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদেরা। তাদের মতে, এতে ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার চেষ্টা স্পষ্ট।
যদিও রাজনৈতিক উত্তাপ, বিতর্ক ও ইতিহাস–রাজনীতি নিয়ে তুমুল আলোচনার কেন্দ্রে তাজমহল বারবার উঠে আসে, তবে বাস্তবের স্থাপনাটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
ইতিহাসবিদ স্বপ্না লিডল বলছেন, “মোগল আমলের নথিপত্র এতটাই সমৃদ্ধ যে তাজমহল নিয়ে বিকল্প তত্ত্ব টিকে থাকার সুযোগই নেই। কিন্তু কিছু চলচ্চিত্র এখন সচেতনভাবে মুসলিম ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে খলনায়ক বানিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করছে-যা বিপজ্জনক।”
১২২ বার পড়া হয়েছে