২৯ নভেম্বর: জর্জ হ্যারিসন আর আমাদের কৃতজ্ঞতার পরীক্ষা
সোমবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩:৫২ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
একটা কুয়াশাভেজা নভেম্বরের সকাল। ঢাকা শহর তার নিজের মতোই জেগে উঠেছে-মগবাজারের মোড়ে চায়ের ধোঁয়া, আরামবাগের গলিতে স্কুলব্যাগ কাঁধে শিশুদের দৌড়, রাস্তাজুড়ে বাস-রিকশার চিরচেনা হর্ন।
মাসের শেষদিনের মতোই ব্যস্ততা, কারও মুখে হিসাব, কারও মুখে রাজনীতি; কিন্তু আকাশের ওপরে কোথাও, বাতাসের ভেতরে, শহরের কোন দেয়ালে লেখা নেই একটি নাম-জর্জ হ্যারিসন। কেউ না জানলেও, ইতিহাস জানে-২০০১ সালের এই ২৯ নভেম্বরেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই মহান বন্ধু। নিরবে, কোন আনুষ্ঠানিক শোকধ্বনি ছাড়াই আবারও কেটে গেল তাঁর প্রয়াণের দিন।
সেই ১৯৭১ সালে অন্য এক আগস্টের দুপুরে রবি শংকর আর জর্জ হ্যারিসন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন ভরিয়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ নামের এক অপরিচিত দেশের আহ্বানে। ভেতরে ভেতরে যুদ্ধ, গণহত্যা, শরণার্থীর আর্তনাদ-সেসব খবর তখনো পশ্চিমা দুনিয়ায় এভাবে পৌঁছায়নি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এক বিটলস তারকা নিজের ব্যান্ড, বন্ধু আর সারা বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। লাখো মানুষ টিকিট কেটে ঢুকল হলে, টিভি ক্যামেরা ঘুরল মঞ্চের দিকে, সঙ্গীতের মাঝে ভেসে উঠল যুদ্ধাহত, ক্ষুধার্ত এক জাতির মুখ। সেই কনসার্টের টাকায় শরণার্থীরা পেল কিছুটা ভরসা, আর বাংলাদেশের নাম পেরিয়ে গেল মানচিত্রের সীমা।
সেদিন তাঁর কণ্ঠে ভেসে এসেছিল এক নতুন শব্দ-“Bangladesh”-একটা অচেনা দেশের নাম, যার প্রতিটি অক্ষরে গেঁথে ছিল মানুষের আর্তনাদ আর আশা। “Bangladesh Bangladesh” গানে জর্জ হ্যারিসন বিশ্ববরেণ্য শিল্পী বন্ধুদের নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।মঞ্চে বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটনের মতো বিশ্বতারকারা একে একে গাইছিলেন; আর সেই গানগুলো পেরিয়ে যাচ্ছিল সীমানা, ঢুকে পড়ছিল শরণার্থীশিবিরের কান্নার ভেতর। কনসার্ট থেকে উঠেছিল বিপুল অর্থ (২৫০০০০ ডলার), যা পৌঁছেছিল শরণার্থীদের সহায়তায়; তার চেয়েও বড় কথা, বাংলাদেশের দুর্দশা আর মুক্তিযুদ্ধের ন্যায্য দাবিটা সেদিন পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বমানবতার দরজায়।
২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর, ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন জর্জ হ্যারিসন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন লিভারপুল থেকে নিউইয়র্ক-বিশ্বজুড়ে তাঁর সংগীত-ভক্তরা শোক পালন করে। জীবনভর যে মানুষটা “মাই সুইট লর্ড”, “গিভ মি পিস অন আর্থ” গেয়ে ভক্তদের হৃদয়ে শান্তি আর আধ্যাত্মিকতার বীজ বুনেছিলেন, তিনিই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়ে উঠেছিলেন মানবতার কণ্ঠস্বর। অথচ তাঁর মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও, বাংলাদেশে তাঁর চলে যাওয়ার দিনটা অধিকাংশ সময়ই কেটে যায় কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়াই-অপেরা হাউসের ঝলমলে আলো নয়, বরং অচেনা অলিগলির মতো নিভৃতে।
ফিরে তাকিয়ে প্রশ্নটা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে-আমরা কি স্মৃতিহীন হয়ে যাচ্ছি? যে জাতি নিজের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লেখা বন্ধুদের নাম উচ্চারণ করতে ভুলে যায়, তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের মানচিত্র কি সম্পূর্ণ থাকবে? জর্জ হ্যারিসনের মতো মানুষকে ভুলে যাওয়া মানে কেবল এক সংগীতশিল্পীকে ভুলে যাওয়া নয়; মানে সেই মানবিক সেতুবন্ধনকে অগ্রাহ্য করা, যেখানে এক পাশের মাটিতে ছিল মুক্তিযোদ্ধার রক্ত, আর অন্য পাশে ছিল এক বিদেশি হৃদয়ের অশ্রু।
তবু আশা থাকে-হয়তো ভবিষ্যতের কোনো এক ২৯ নভেম্বর, এই শহরের সকালটা একটু আলাদা হবে। কোনো স্কুলের শিশুদের সারিতে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে, কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের দেয়ালে লেখা থাকবে-“আজ জর্জ হ্যারিসনের প্রয়াণদিবস; বাংলাদেশের পরম বন্ধুকে স্মরণ করি।” কোনো টেলিভিশন আলোচনায় শোনা যাবে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের গল্প, কোনো শহীদ মিনারের সামনে মোমবাতির আলোয় উচ্চারিত হবে তাঁর নাম। হয়তো তখন এই প্রশ্নের উত্তর আমরা একটু গর্ব নিয়ে বলতে পারব-না, আমরা অকৃতজ্ঞ নই; আমরা দেরিতে হলেও কৃতজ্ঞতা শিখেছি।
তার আগে, এই নীরব শহরেই, একজন সাংবাদিকের কলমে, একজন পাঠকের চোখের জলে, একজন কিশোরের কাঁধে ঝুলে থাকা হেডফোনে জর্জ হ্যারিসন আবারও ফিরে আসতে পারেন-একজন মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা, এক নিঃস্বার্থ বন্ধু আর এক মহান মানুষের মতো। আর ২০০১ সালের সেই ২৯ নভেম্বরের নীরব চলে যাওয়াটাকে আমরা নতুনভাবে লিখতে পারি-“হ্যাঁ, তিনি সেদিন চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তাঁকে আর কখনো ভুলে যাইনি।”
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
১২০ বার পড়া হয়েছে