রম্য কথা
চট্টগ্রাম বন্দর: জাহাজ ভাসে, ভাগ যায় উপরে
শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:০৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
গভীর সমুদ্রে তখনও ‘গুপ্তধনের জাহাজ’, আর ডাঙায় তখন ‘গুপ্তচোরের নাটক’। পেঁয়াজের দামে সাধারণ মানুষের চোখে পানি, কিন্তু বন্দর–বাণিজ্য-সিন্ডিকেটের চোখে শুধু টাকা আর টাকা। দোজখের আঁচ তখন বাজারে, আর স্বর্গের হাওয়া বইছিল জাহাজের কেবিনে।
গ্রাম বন্দরের সামনে যেন একেকটা মহাভারত মঞ্চায়ন হয়—নায়ক নেই, সবগুলোই খলনায়ক।
এখানে পণ্য খালাস মানেই নাকি ৬০ ঘাটে সালামি, আসলে এটা সালামি না, রাষ্ট্রযজ্ঞের ‘আহুতি’—ফারাক শুধু, দেবতা আর পূজারি দুজনেই একই গডফাদার।
বছরের পর বছর একই স্ক্রিপ্ট, শুধু সরকারের নাম পাল্টায়, মন্ত্রীর গাড়ির প্লেট পাল্টায়, কিন্তু ঘাটের কমিশনার থেকে শুরু করে পাহারাদার পর্যন্ত সবার মুখে একই ডায়লগ—“বাবু, সিস্টেম তো এই রকমই!”
১৯৯৯-এর সেই পেঁয়াজ-সংকটে গভীর সমুদ্রে তুরস্কি জাহাজ দুটো ভাসতে ভাসতে মনে হয় ভাবছিল, “ডাঙার মানুষগুলো যদি কাঁদতেই পছন্দ করে, আমদের গিয়ে আর কী লাভ?”
ডাঙায় তখন এমন কান্না, মনে হয় পুরো জাতি যেন পেঁয়াজ কাটছে, আর সিন্ডিকেটের অফিসে চলছে হাসির যোগব্যায়াম—প্রতি কেজি পেঁয়াজের একেকটা দাঁত বের করে হাসছে।
শেষমেশ সমালোচনার চাপে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে এসে জাহাজ টানতে টানতে বন্দরে ঢুকিয়ে দিলেন—দেশের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো মন্ত্রী ‘হিউম্যান টাগবোট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন!
এস আলমের মাথায় তখন আকাশ ভাঙল ঠিকই, কিন্তু পেঁয়াজের বস্তার নিচে চাপা পড়ে গেল মানুষের দীর্ঘশ্বাস।
সাইফুল আলম মাসুদের তখনকার অবস্থাটা ছিল একেবারে টেলিভিশন নাটকের সাপোর্টিং ভিলেনের মতো—ডাকাত সর্দার হওয়ার আগে স্টান্টম্যান হিসেবে রিহার্সাল চালু।
গভীর সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় উড়ছিল গোপন লেনদেনের গন্ধ, আর বন্দরের বড় কর্তারা নাকে রুমাল চেপে বলছিলেন, “আহা, কী সুন্দর সাগর-বাতাস!”
বন্দর মানেই এক অদ্ভুত রিপাবলিক—এখানে জাতীয় পাখি ‘টেন্ডার’, জাতীয় ফুল ‘এলসি’, আর জাতীয় সঙ্গীত ‘ফাইল আটকে রাখো’।
খালাস থেকে ডেলিভারি—প্রতিটি ধাপেই যেন টোল প্লাজা; একেকটা সালামির পর পণ্য দেখে মনে হয়, মালিকের না, সিস্টেমের নামে ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছে’।
এই ১৮ বছরে নানা অদৃশ্য পাওয়ারটেক বন্দরটাকে এমন চিবিয়ে খেয়েছে যে এখন পাইলট বোটের সাইরেন শোনামাত্রই বঙ্গভবন পর্যন্ত পৌঁছে যায় ভাগের ডাক।
এখন যখন কিছু টার্মিনাল বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার কথা হচ্ছে, তখনই শুরু হয়েছে নতুন নাট্যমেলা—‘দেশ বাঁচাও, বন্দর বাঁচাও, আমাদের ভাগও বাঁচাও।’
যারা বছর বছর বন্দরকে এটিএম বুথ বানিয়ে রেখেছিল, তারা আজ হঠাৎ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কাঁদুনি-নায়িকা সেজে দাবি তুলছে—“বন্দর বেচে দিচ্ছে, বন্দর যাবে বিদেশিদের হাতে!”
বাস্তবতা হলো, শত কোটি টাকার ভাগ হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই এই সম্মিলিত আন্দোলন; দেশপ্রেম শুধু পোস্টার আর মাইক ভাড়ার বিলের ভেতর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
গভীর সমুদ্রে গুপ্তধনের জাহাজ ভাসে, বন্দরে গুপ্তচোরের সিন্ডিকেট, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে বেচারা সাধারণ মানুষ—কখনো পেঁয়াজের কান্নায়, কখনো কন্টেইনার জটের দুঃস্বপ্নে।
যতদিন বন্দরকে ‘জাতীয় সম্পদ’ না ভেবে ‘জাতীয় ভাগ-বাঁটোয়ারার মেশিন’ ভাবা হবে, ততদিন এই গল্পই চলবে—শুধু পণ্য বদলাবে, জাহাজ বদলাবে, কিন্তু চিত্রনাট্য একই থাকবে।
তাই এখনকার বন্দর-বিরোধী আন্দোলনের স্লোগানকে সামান্য বদলালেই হয়তো বাস্তবের সঙ্গে একটু বেশি মিলে যায়—“বন্দর বিদেশিদের নয়, আমাদের ভাগের বাইরে যাবে না!”
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১১৬ বার পড়া হয়েছে