সর্বশেষ

জাতীয়টঙ্গীতে শুরায়ী নেজামের আয়োজনে পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা শুরু
সারাদেশত্রিশালে বন্ধুকে কুড়াল দিয়ে হত্যা, থানায় আত্মসমর্পণ
ধামরাইয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা বাসে অগ্নিকাণ্ড
হিমালয়ের ঠান্ডা হাওয়ায় জমে উঠছে তেঁতুলিয়া, তাপমাত্রা ১৩.২ ডিগ্রি
আন্তর্জাতিকহংকংয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড: ৯৪ জনের মৃত্যু, উদ্ধার অভিযান শেষ পর্যায়ে
খেলাসিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে বড় হার, তবুও আশাবাদী লিটন দাস
ফিচার

লালন সাঁই মানবতাবাদী, নাকি ধর্মবিদ্বেষী? সাম্প্রতিক বক্তৃতা–ঝড়ের অন্তরালের সত্য

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ ৪:০০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে আবুল সরকারসহ বাউল ও পালা গানের শিল্পীদের ঘিরে “ধর্ম অবমাননা” ইস্যুতে যেভাবে মব সহিংসতা ও গ্রেফতার চলছে, তা লালন সাঁই ও ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ীকে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

তৌহিদী জনতা ধরনের গোষ্ঠী কিছু কাটা–ছেঁড়া বক্তব্য ধরে “বাউল মানেই ইসলামবিরোধী” এই ধারণা ছড়িয়ে লালনকে আইডল টার্গেট বানাতে চাইছে—এটা শুধু একটি সাধকের বিরুদ্ধে নয়, পুরো মানবতাবাদী লোক–আধ্যাত্মিক ধারার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রকল্প।

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট: আবুল সরকার, তৌহিদী জনতা ও বাউল–বিরোধী মব
সাম্প্রতিক ঘটনায় জনপ্রিয় বাউল শিল্পী আবুল সরকারকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, এবং তার অনুসারীদের ওপর তৌহিদী জনতা–ঘনিষ্ঠ মবের হামলা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনগুলো বলছে—এই গ্রেফতার ও হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; “ধর্মীয় অনুভূতি”কে অস্ত্র বানিয়ে মাজার, বাউল, সুফি, সংখ্যালঘু উপাসনালয় ও সাংস্কৃতিক আসরে হামলার একটি ধারাবাহিক রাজনীতি চলছে, যা নতুন ধরনের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের রূপ নিচ্ছে।
এই ধারাবাহিক আক্রমণের ভুক্তভোগী কেবল একজন–দু’জন শিল্পী নন; রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ক’বছরে শতাধিক মাজার ভাঙচুর, বাউল–ফকিরের গায়ে হাত তোলা, চুল কেটে দেওয়া, “কাফের/মুরতাদ” তকমা লাগানো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আবুল সরকার ইস্যু সেই বড় চিত্রেরই সর্বশেষ পর্ব, যা স্বভাবতই লালন সাঁই–কেন্দ্রিক ছেঁউড়িয়া আখড়াকে সরাসরি ঝুঁকির মুখে নিয়ে আসে।

লালনের দর্শন: মানবতাবাদী “মানুষধর্ম” বনাম ধর্মব্যবসা
সমসাময়িক গবেষণায় লালনকে স্পষ্টভাবে “non-sectarian reformer”, “মানবতাবাদী সাধক” এবং সামাজিক–ধর্মীয় কুসংস্কার–বিরোধী দার্শনিক হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাঁর গানের কেন্দ্রে আছে:
* জাতপাত ও বর্ণব্যবস্থার বিরোধিতা।
* নারী–পুরুষ, হিন্দু–মুসলমান, ধনী–গরিব—সব ভেদাভেদ অতিক্রমের ডাক।
* আচার–অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক ভণ্ড ধর্মচর্চা ও ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
* “মনের মানুষ”–এর সন্ধান, অর্থাৎ অন্তরের শুদ্ধি ও মানবতার বিকাশ।
লালন সংগঠিত ধর্মকে গালি দেননি; তিনি আঘাত করেছেন গোঁড়ামি, ভণ্ডামি, জাত–পাত ও হিংস্র সাম্প্রদায়িকতার ওপর। তাঁর গানে মসজিদ–মন্দির দু’পক্ষরই সমালোচনা আছে—কিন্তু আল্লাহ, তাওহিদ বা ঈশ্বর–বিশ্বাসকে অবমাননা নেই; বরং আড়ম্বরপূর্ণ রীতিনীতি ছেড়ে “দেহ–মন শুদ্ধির” ঈমানি পথের ডাক আছে। এই ইতিহাসকে উপেক্ষা করে আজকে লালনকে “ইসলামবিদ্বেষী” বানানো আসলে তথ্য–বিকৃতি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক “ধর্ম ব্যবসা”।

গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ নিয়ে ভ্রান্ত প্রচার
গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র “মনের মানুষ” মূলত লালনের জীবন ও বাউল দর্শনের এক মানবতাবাদী, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে অবস্থান নেওয়া চিত্রায়ন—এতে নবী মুহাম্মদকে (সা.) অবমাননার কোনো কাহিনি বা ইঙ্গিত নেই। ছবিতে লালনকে দেখানো হয়েছে এক আধ্যাত্মিক গুরু–সাধক হিসেবে, যিনি জাতপাত ও হিন্দু–মুসলিম বিভাজনের বিরুদ্ধে কথা বলেন; তাঁকে কোথাও “নবীর সমতুল্য” বা “নবীর বিকল্প” হিসেবে দেখানোর দাবি গবেষণা ও সমালোচনায় সমর্থন পায় না।
বর্তমানে কিছু বক্তা ইচ্ছাকৃতভাবে এই চলচ্চিত্রের নাম টেনে সাধু–পুরুষ, পীর–ফকির বা বাউল গুরু মানেই “ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী রাসুল”—এমন একটা ভুল তুলনা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। এটা সাধারণ মুসলিম জনতাকে উত্তেজিত করার ভাষা, যার কোনো নৈতিক বা শৈল্পিক ভিত্তি নেই।

ছেঁউড়িয়া আখড়া: স্থানীয় সমাজ, ভক্তি ও সম্ভাব্য সংঘাত
সরকারি ও স্বাধীন বিভিন্ন উৎসই বলছে—কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়া স্থানীয় মানুষের কাছে গর্ব, অর্থনৈতিক সুযোগ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রধান কেন্দ্র। এলাকাবাসীর বড় অংশ লালনকে সাধক ও লোকসন্ত হিসেবে শ্রদ্ধা করে; মেলা ও উৎসবকে ঘিরে অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে এবং এলাকার ব্র্যান্ডিং–এ “লালন” প্রধান পরিচয়।
এই বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে যদি তৌহিদী জনতা ধরনের গোষ্ঠী বাইরে থেকে মব এনে আখড়ায় আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে, তাহলে তা কেবল বাউল–ফকিরদের সঙ্গে নয়, স্থানীয় জনগণের সাথেও সরাসরি সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
সম্ভাব্য দৃশ্যগুলো হলো:
* আক্রমণ ঠেকাতে স্থানীয় মানুষ, ব্যবসায়ী, ভক্ত, তরুণরা রাস্তায় নেমে বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, এমনকি অস্ত্রসহ সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি হবে।
* বড় ধরনের ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ হলে পুলিশ–বিজিবি নামতে বাধ্য হবে; তখন গুলিবর্ষণ বা মারাত্মক রক্তক্ষয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে, যার মূল শিকার হবে স্থানীয় গরিব মানুষ ও নিরস্ত্র ভক্তরা।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার নজির (পূজামণ্ডপ, মন্দির, মাজার, সংখ্যালঘু এলাকা ইত্যাদিতে) দেখায়—একবার মব ছুটে এলে স্থানীয়দের শ্রদ্ধা বা অসন্তোষ, দুটোই প্রায়ই মাড়িয়ে যায়; পরে কেবল লাশ, মামলা আর ভাঙা ঐতিহ্য পড়ে থাকে। তাই ছেঁউড়িয়ায় কোনো এমন হামলা হলে, তা এক ভয়াবহ রক্তাক্ত সংঘাতে গড়ানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কেন লালনকে টার্গেট করা হচ্ছে: মতাদর্শ বনাম ধর্মব‍্যবসা
বিভিন্ন বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের বাউল–সুফি ঐতিহ্যকে আজ “শত্রু” বানাচ্ছে যে গোষ্ঠী, তারা নিজেদেরকে ইসলাম–রক্ষাকারী তৌহিদী শক্তি হিসেবে তুলে ধরলেও, বাস্তবে তারা ভিন্নধর্মী ঐতিহ্য–বিরোধী একধরনের রাজনৈতিক ইসলাম কায়েম করতে চায়। এদের কৌশল সাধারণত এমন:
* কোনো একটি বক্তব্য/ভিডিও থেকে কাটা ক্লিপ তুলে এনে “ধর্ম অবমাননা” অভিযোগ তৈরি করা।
* অনলাইনে ও মসজিদে প্রচার চালিয়ে জনমত উত্তেজিত করা।
* মব তৈরি করে হামলা বা ঘেরাও—একই সঙ্গে পুলিশকে চাপ দিয়ে মামলা ও গ্রেফতার আদায় করে নেওয়া।
লালনের দর্শন সরাসরি এ রাজনীতির বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে—
* তিনি ধর্মকে বর্ণ, জাতপাত, নারী–পুরুষ বৈষম্য ও হিংস্রতার হাতিয়ার বানানোকে অস্বীকার করেছেন।
* তিনি আচার–অনুষ্ঠান নয়, অন্তরের মানবতার ভিত্তিতে ঈশ্বর–অন্বেষণের কথা বলেছেন।
এই মানবতাবাদী “মানুষধর্ম” সেই সব ধর্মব্যবসার স্বার্থের বিরোধী, যা মানুষের ভয় ও ঘৃণাকে পুঁজি করে। তাই লালনকে আজকের এই আক্রমণাত্মক তৌহিদী রাজনীতির সামনে অন্যতম বড় বৌদ্ধিক–নৈতিক বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে; ফলত তাঁকে ও তাঁর আখড়াকে “শয়তানের ঘাঁটি” বানিয়ে জনগণের চোখে ছোট করার অপচেষ্টা বাড়ছে।

লালনের উত্তরাধিকার রক্ষার লড়াই: সংস্কৃতি বনাম জবরদস্তি
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ, শিল্পী–লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এমনকি কিছু রাজনৈতিক নেতাও স্পষ্ট কথা বলা শুরু করেছেন—বাউল, সুফি, লালন ঐতিহ্যের ওপর হামলা মানে শুধু কিছু শিল্পীর ওপর আক্রমণ নয়; এটা দেশের বহুত্ববাদী ঐতিহ্য, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মৌলিক স্বাধীনতার ওপর আঘাত। Transparency International Bangladesh, ASK, বিভিন্ন নারী–অধিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সাম্প্রতিক বিবৃতিতে সতর্ক করেছে—এই ধরনের মব–নীতি চলতে দিলে “ভিন্ন বিশ্বাস বা চর্চাকারী সবাইকে বাদ দেওয়া”–ধরনের এক সামগ্রিক শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে।
একই সঙ্গে, বহু গবেষণা ও প্রবন্ধে নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে—
* লালনের গানে মানুষ, প্রেম, সহনশীলতা এবং আত্ম–সমালোচনার শিক্ষা আছে।
* তাঁর গান বাংলাদেশের সেক্যুলার–মানবতাবাদী রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক উৎস।
* লালনবিরোধী বিদ্বেষ আসলে এই ধারার রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার কৌশল।

লালনের আখড়া আক্রমণ মানে কী হারাবো আমরা
যদি তথাকথিত তৌহিদী জনতার মব কোনও দিন ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ীকে সরাসরি আক্রমণ করে, তবে সেটা কেবল একটি মাজার বা কয়েকজন বাউলের ওপর হামলা হবে না—
* বাংলাদেশের বহু শতাব্দীর লোকায়ত, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের হৃদয়ে আঘাত হবে।
* কুষ্টিয়া–ভিত্তিক একটি পুরো এলাকার অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সামাজিক শান্তি ভেঙে পড়বে।
* রাষ্ট্রের ধর্মীয় সহনশীলতা–সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি বিশ্বমঞ্চে গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়বে।
• ভিন্নমত, ভিন্নধর্মী আধ্যাত্মিকতা ও লোকশিল্প চর্চায় আরও ভয়, আত্ম–সেন্সরশিপ ও নীরবতা নেমে আসবে।

লালন ছিলেন ও আছেন এমন এক সাধক, যিনি বলেছেন—মানুষকেই মানুষ হিসেবে দেখো, ভেদ–বিভেদ ও কুসংস্কার ভাঙো, ভয় আর ঘৃণার বদলে প্রেম আর সমতার পথ শিখো। আজকে যখন ধর্মব‍্যবসায়ী শ্রেণী তাঁকে টার্গেট করছে, তখন আসলে তাদের লক্ষ্য লালনের সেই মানবতাবাদী “মানুষধর্ম”–কেই গলা টিপে ধরা। সেই আক্রমণ ঠেকানো মানে কেবল একজন ফকিরকে রক্ষা নয়—বাংলাদেশের বহু–ধর্ম, বহু–সংস্কৃতির সহাবস্থানের আত্মাটাকেই রক্ষা করা।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

১১৯ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন














সর্বশেষ সব খবর
ফিচার নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন