সর্বশেষ

মতামত

আওয়ামী লীগ কেন টিকে আছে

অঞ্জন সৈকত
অঞ্জন সৈকত

মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫ ৫:০৬ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ একটি অনন্য রাজনৈতিক সত্তা। শুধু একটি দল নয়, বরং রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক প্রধান ধারক।

প্রায় আট দশকের রাজনৈতিক পথচলায় দলটি বারবার সংকট, দমন-পীড়ন, সামরিক শাসন এবং ক্ষমতাচ্যুতি সামলেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ড দলটিকে শুধু নেতৃত্বহীনই করেনি, বরং অনেকের চোখে দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

তবুও ইতিহাস প্রমাণ করে- আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যার রাজনৈতিক ভিত্তি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সামাজিক স্মৃতির গভীরে স্থাপিত। এই গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণে দলটির সাংগঠনিক স্থিতি, আদর্শিক শেকড়, রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংকট-অতিক্রমের ক্ষমতা নিয়ে তথ্যনির্ভর পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হলো-

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে ১৯৪৯ সালে, যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

গবেষক রিচার্ড উইলিয়ামসন, স্ট্যানলি উলফ, ব্যারিংটন মুর প্রমুখ দেখিয়েছেন- কোনো রাজনৈতিক দল যদি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে জন্ম নেয়, তখন তা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়।

ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন (১৯৫৪), স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন (৬ দফা), গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯)- এসব ঐতিহাসিক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। যা দলটিকে দিয়েছে- ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বৈধতা, জাতীয় স্মৃতিতে বিশেষ স্থান, জনমতের গভীর শেকড়।

বিশ্ব রাজনৈতিক তত্ত্ব বলে- state-founding party বা রাষ্ট্রগঠনে নেতৃত্বদানকারী দলগুলো সাধারণত দীর্ঘ সময় টিকে যায়।

উদাহরণ: ANC (দক্ষিণ আফ্রিকা), Indian National Congress, FRELIMO (মোজাম্বিক), CPP (ঘানা, নকর্মাহ পরবর্তী সময়ে)

আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা যায়- মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দলের নৈতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যে, এটি সহজে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।

গবেষণামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি বৈধতা দেখা যায়-

ঐতিহাসিক বৈধতা : স্বাধীনতার নেতৃত্ব। জনমতের বৈধতা : জনগণের রাজনৈতিক স্মৃতি। রাজনৈতিক-আদর্শিক বৈধতা : বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের দাবি।

১৯৭৫-১৯৯০: দমন-পীড়ন, নিষেধাজ্ঞা ও পুনরুত্থান, ১৯৭৫-১৯৮১: সেনাশাসন দলটিকে নিষিদ্ধ করে নি ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রায় অকার্যকর করে দেয়। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দলটি পুনর্গঠনের পর্যায়ে প্রবেশ করে।

রাজনীতি-বিজ্ঞান অনুযায়ী, কোনো দল টিকে থাকে যদি- সাংগঠনিক বিস্তার থাকে, গ্রামীণ ভোটব্যাংক বজায় থাকে, আদর্শিক ন্যারেটিভ দৃঢ় থাকে, প্রজন্মগত নেতৃত্ব স্থানান্তর সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে চারটিই প্রযোজ্য।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে- Bangladesh Political Party Mapping Project (2014) অনুসারে- আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত দলটিকে সমর্থন জোগায়। সামরিক শাসনে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নিষ্ক্রিয় থাকলেও grass-roots organizational resilience দলটিকে ভেঙে পড়তে দেয়নি।

গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের পর যেকোনো শাসকদল সাধারণত জনমতের চাপে পড়ে। এটি সাময়িকভাবে সাংগঠনিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। যে কোনো শীর্ষ নেতৃত্ব আইনি বা রাজনৈতিক চাপে পড়লে দলটির অভ্যন্তরীণ সংগঠন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। তবে ইতিহাস দেখিয়েছে-
১৯৮১ শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন, ২০০৭-২০০৮ জরুরি সরকার। প্রতিটি সংকটেই দলটি নেতৃত্বের চারপাশে পুনরায় সংগঠিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরে বৈশ্বিক কূটনীতির কেন্দ্রে সক্রিয়। দলটির বৈশ্বিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা রয়েছে-
ভারতীয় ভূরাজনীতি, চীনা অর্থনৈতিক প্রভাব, পশ্চিমা শক্তির গণতান্ত্রিক চাপ, OIC- কেন্দ্রিক মুসলিম বিশ্বের কূটনীতি। এই বহুমাত্রিক সম্পর্ক দলটিকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেললেও সুযোগও সৃষ্টি করে।

সংকট অতিক্রমে দলগুলোর টিকে থাকা রাজনীতিতে “party survival theory (Harmel & Janda, 1994)” বলে- দল টিকে থাকে যখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিযোজিত হতে পারে।

আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে দেখা যায়- ঐতিহাসিক শেকড়, মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রগঠন, শক্তিশালী বৈধতা, সাংগঠনিক বিস্তার, গ্রাম-শহরে স্থায়ী নেটওয়ার্ক, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা, আদর্শিক ন্যারেটিভ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নেতৃত্ব, উত্তরাধিকারভিত্তিক স্থিতিশীলতা, সংকট অতিক্রম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতি কৌশলগত সুবিধা।

এই সূচকগুলো প্রমাণ করে- সংকট যত গভীরই হোক, দলটির অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

রাজনৈতিক দলে 'অর্গানাইজেশনাল মেমোরি' বলে একটি ধারণা আছে- যেসব দল বহু প্রজন্ম ধরে রাজনৈতিক লড়াই করেছে, তাদের কর্মীসংগঠনে একটি 'অভ্যস্ততা' তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগও তেমন- সামরিক শাসন সহ্য করেছে, দমন-পীড়নের ইতিহাস আছে, কারাবরণ ও আন্দোলনের সংস্কৃতি আছে ফলে সংকট এলে কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয় না।

সাম্প্রতিক গবেষণা (BRAC Institute of Governance, BIGD; United Nations University, CPD স্টাডি) দেখায়-
গ্রামীণ ও প্রান্তিক ভোটারদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন বহু দশক ধরে স্থিতিশীল।

যে দল গ্রামভিত্তিক নেটওয়ার্ক হারায় না- সে দল খুব সহজে বিলীন হয় না।

আওয়ামী লীগ অতীতে একাধিকবার নিজের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ বদলে সফল হয়েছে-
১৯৮০-৯০: গণতন্ত্র আন্দোলনের দল, ১৯৯৬: উন্নয়ন ও প্রজ্ঞাপন-ভিত্তিক শাসন ২০০৮-২০২২: ডিজিটাল বাংলাদেশ ও উন্নয়নমুখী শাসন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবার নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করার সুযোগ দলটির আছে।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি state-making party- এটি শুধু ভোটের রাজনীতিতে টিকেই নেই, বরং রাষ্ট্রকাঠামো, সামাজিক স্মৃতি, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার অংশ হয়ে গেছে।

অতীতের অভিজ্ঞতা বলে- ১৯৭৫-৮০: নেতৃত্বহীন অবস্থায়ও টিকে গেছে, ১৯৮১-৯০: দমননীতির পরেও উঠে এসেছে, ২০০৭-০৮: শীর্ষ নেতৃত্বের কারাবরণ সত্ত্বেও সংগঠিত হয়েছে, ফলে বর্তমান সংকটও দলটির অস্তিত্ব ধ্বংস করতে পারবে- এমন ধারণা রাজনৈতিক তত্ত্ব ও গবেষণা সমর্থন করে না।

রাজনৈতিক দলগুলো অদৃশ্য হয় তখনই- যখন তাদের সামাজিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে। বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সেই ভিত্তি এখনো অক্ষয়।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক। 

১৭৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন