সর্বশেষ

ধর্ম

খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ) মসজিদ কমপ্লেক্স: দক্ষিণ বাংলার ইসলামী ঐতিহ্যের এক জীবন্ত নিদর্শন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫ ২:৩০ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
বাংলার সুফি ঐতিহ্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য নাম হযরত আল্লামা শাহ সুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ)।

১৮ শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তিনি ছিলেন একাধারে আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক সাধক, ও সমাজসংস্কারক। তাঁর দাওয়াতি কর্মকাণ্ড শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি সমাজে নৈতিক পুনর্জাগরণ, শিক্ষার প্রসার এবং মানবতার আদর্শ প্রচারে আজীবন নিবেদিত ছিলেন। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত “শাহ সুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) জামে মসজিদ কমপ্লেক্স” দক্ষিণ বাংলার ইসলামী ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে আজও ইসলামের বাতিঘর হিসেবে টিকে আছে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ

১৮ শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বৃটিশ শাসনের কঠোর দমননীতির মধ্যেও বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে ইসলামী আন্দোলন ও সুফি চেতনা বিকশিত হচ্ছিল। এই সময়েই ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বহু সুফি সাধক বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা এলাকায় আগমন করেন। এমনই এক সময়ে, ইংরেজি ১৯০০ সালে (প্রায় ১২৫ বছর পূর্বে), বর্তমান বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের বালিয়াতলী গ্রামে শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) প্রতিষ্ঠা করেন একটি জুমা মসজিদ—যা পরবর্তীতে “খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) মসজিদ কমপ্লেক্স” নামে পরিচিত হয়।

এই অঞ্চলটি ছিল তখনকার বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলীয় জনপদ, যেখানে নৌপথে বাণিজ্যের পাশাপাশি ধর্মপ্রচারকারীদের চলাচলও ছিল উল্লেখযোগ্য। পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত এই বালিয়াতলী গ্রাম দক্ষিণ বাংলার ইসলামী শিক্ষা ও সুফিবাদের এক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।

আধ্যাত্মিক বংশধারা ও পীর-মুরিদ সম্পর্কঃ

শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ) ছিলেন বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর বংশধর শাহ সুলতান সৈয়দ বোগদাদী (রহঃ)-এর একান্ত সহচর-মুরিদ ও খলিফা। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, শাহ সুলতান সৈয়দ বোগদাদী (রহঃ) ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে ভারতে আসেন—প্রথমে আসাম ও উড়িষ্যা অঞ্চলে, পরে বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চলে। তাঁর হাতেই শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) শিক্ষা লাভ করেন এলমে শরীয়ত, মারেফাত ও তাসাউফের জ্ঞান।

পীরের নির্দেশে ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) নিজ গ্রামের বাড়িতে একটি জুমা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে ধর্মপ্রচার, নামাজ ও আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক কাজও পরিচালিত হয়। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মৌলভী খাজা নাছের আলী (রহঃ) ছিলেন এই মসজিদের মূল সহযোগী ও প্রথম ইমাম। কাঠ, ছন, গাইট্টা ও হেতাল কাঠ দিয়ে নির্মিত প্রথম দিকের সেই মসজিদ ছিল একেবারেই প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি—যার প্রতিটি কাঠামোয় ছিল আল্লাহভীতি ও পীরের আদেশের প্রতি নিষ্ঠার ছাপ।

ইসলাম প্রচার ও সমাজসংস্কারঃ

শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) দক্ষিণ বাংলায় ইসলামী শিক্ষা প্রচারের পাশাপাশি সমাজে নৈতিকতার পুনর্জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত খানকা ও মসজিদ ছিল তৎকালীন সময়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তার প্রতিষ্ঠিত "গাউসুল আজম খানকা শরীফ"- এখানে নিয়মিত ওয়াজ-মাহফিল, কিরাত, দরস এবং দরবারি মুরাকাবা হতো।

তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে অসংখ্য অমুসলিম ও গোমরাহ মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেই সময়ে সমুদ্রতীরবর্তী এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ছিল গভীর; শাহ সুফী ফয়জ উদ্দীন (রঃ) উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মানবিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে উদ্যোগী ছিলেন। ফলে তাঁর মসজিদটি শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং ছিল সামাজিক সংহতি ও আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রতীক।


মসজিদে আগত পীর- মাশায়েখগণঃ


এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন উপমহাদেশের বহু প্রখ্যাত পীর ও আলেম। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, এখানে তাশরীফ এনেছিলেন—
১. বড় পীরের আওলাদ হযরত শাহ সুলতান সৈয়দ বোগদাদী (রঃ) ও তাঁর সহচরগণ।
২. ছারছীনা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম, মোজাদ্দেদে জামান হযরত শাহ নেছারউদ্দিন আহমদ (রঃ)।
৩. ছারছীনা শরীফের পীর শাহ সুফী মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রঃ)।
৪. পাঙ্গাশিয়া দরবারের প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ সুফী হাতেম আলী (রঃ)।
৫. পাঙ্গাশিয়া দরবারের ওলি ও পীরে কামেল হযরত শাহ মোহাম্মদ আমিন ছাহেব (রঃ)।
৬. বর্তমান যুগের আলা হযরত পীর কেবলা হযরত শাহ মোহাম্মদ ওলিউল্লাহ (দা:বা:আ:)।
৭. জৈনপুর খান্দানের আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা জাফর আহমেদ সিদ্দিকী আল-কোরাইশী (রঃ)-এর খলিফা হযরত মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক (রহঃ)।

এছাড়াও অগণিত আলেম-ওলামা, দরবেশ ও সুফি সাধক বিভিন্ন সময়ে এই মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেছেন এবং দাওয়াতি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন।

স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও অলৌকিক ঘটনাবলীঃ

প্রায় ১২৫ বছর ধরে মসজিদটি ঘিরে বহু অলৌকিক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয় জনগণের মুখে মুখে চলে আসা এই ঘটনাগুলো মসজিদের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যকে আরও গভীর করেছে।

১. জ্বীনের নামাজ — অনেকেই বিশ্বাস করেন, গভীর রাতে সাহাবী জ্বীনরা এখানে জামাতে নামাজ আদায় করেন।
২. দোয়া কবুলের স্থান — কেউ বলেন, মসজিদে এসে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয়, তা পূর্ণ হয়।
৩. মাটির বরকত — মসজিদের মাটি বাড়িতে রাখলে উঁই পোকার উপদ্রব হয় না বলে বিশ্বাস।
৪. ধূলির শিফা — মসজিদের ধূলি শরীরে মাখলে ব্যাধি বা চর্মরোগ থেকে মুক্তি মেলে।
৫. মানতের পূরণ — বহু মানুষ মানত করে এখানে আসেন; কেউ রোগমুক্তিতে, কেউ শান্তি ও বরকতের আশায়।

যদিও এসব বিশ্বাস ধর্মীয়ভাবে কুসংস্কারের সীমা ছুঁয়ে যায়, তবুও সুফিবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনাকে “বারাকাত” বা আধ্যাত্মিক প্রভাবের প্রকাশ হিসেবে দেখা যায়।

স্থাপত্য ও রক্ষণাবেক্ষণঃ

প্রথমদিকে ছন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি পরবর্তীতে টিন ও ইটের কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি “শাহ সুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) জামে মসজিদ কমপ্লেক্স” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একটি মাদ্রাসা, খানকা এবং লাইব্রেরি।

বর্তমান খাদেম বা মতোয়াল্লীঃ


বর্তমানে শাহ সুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) জামে মসজিদ কমপ্লেক্সের খাদেম ও মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর দৌহিত্র বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ ইসমাইল (দা.বা.). তাঁর আধ্যাত্মিক তত্ত্বাবধানে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা আজও দীন প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় জনগণ ও দূর-দূরান্তের মুরিদ-ভক্তরা তাঁর নেতৃত্বে নিয়মিত ধর্মীয় শিক্ষা, জিকির-আসকার ও ইসলামী সংস্কৃতির অনুশীলনে অংশগ্রহণ করেন। মাওলানা ইসমাইল তাঁর পূর্বপুরুষদের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার ধারণ করে সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর নিষ্ঠা ও নেতৃত্বে এই মসজিদ কমপ্লেক্স দক্ষিণ বঙ্গের ইসলামী ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে আজও দীপ্তমান।

স্থানীয় মুসল্লি ও ভক্তবৃন্দের আর্থিক সহায়তায় এর সংস্কার কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর দুই ঈদ,ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ), লাইলাতুল কদর, এবং শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রঃ) এবং খাজা নাছের আলী রহ -এর ঈছালে সওয়াব উপলক্ষে বহু মানুষ এখানে সমবেত হন।

সুফি ভাবধারার ধারাবাহিকতাঃ

শাহ সুফী ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ)-এর শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সাধনা ছিল কাদেরিয়া তরিকার আদলে প্রতিষ্ঠিত। তিনি আত্মশুদ্ধি, তাওহিদ ও খলাসের ওপর জোর দিতেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামী জীবন মানে শুধু নামাজ-রোজা নয়, বরং নৈতিকতা, মানবতা ও ইখলাসের সমন্বয়।

তাঁর উত্তরসূরি ও পরিবারের সদস্যরা এই সুফি চেতনার ধারাবাহিকতা আজও রক্ষা করে চলেছেন। বালিয়াতলী গ্রাম তাই আজও দক্ষিণাঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা, তাসাউফ ও মানবিক মূল্যবোধের এক আলোকবর্তিকা।

শাহ সুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহঃ) জামে মসজিদ কমপ্লেক্স শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়—এটি বাংলার সুফি ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল। এখানে নিহিত আছে দক্ষিণ বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাস, পীর-মুরিদের সম্পর্ক, ও ইসলামী সমাজজীবনের বিকাশের গল্প।

এই মসজিদ আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ—যার আলোয় বাংলার মুসলমান সমাজ বারবার ফিরে পায় ঈমান, ভালোবাসা ও মানবতার সত্যস্বরূপ।

তথ্য সূত্র:
১. স্থানীয় ইতিহাস সংগ্রহ (বালিয়াতলী গ্রাম আর্কাইভ, বরগুনা),
২. “তাসাউফ ও বঙ্গীয় সুফিবাদ,” ড. আবদুল কুদ্দুস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ২০০৪।
৩. মৌখিক সাক্ষাৎকার: খাজা পরিবার ও স্থানীয় প্রবীণগণ, বালিয়াতলী, ২০২৪।
৪. জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিন।

 

১২৪ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
ধর্ম নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন