সর্বশেষ

সাহিত্য

কবিতায় ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ্য ও সমাজ-চৈতন্যর আলোড়ন 

গাউসুর রহমান 
গাউসুর রহমান 

শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫ ৭:৫২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
কবিতা শিল্পের এমন এক অনন্য ও নিগূঢ় মাধ্যম, যা একই স্পন্দনে ধ্বনিত করে ব্যক্তিমনের গহীন অন্তঃসলিলা ও সমাজ-নামক বৃহত্তর জীবনের জটিল বুনট। এটি একদিকে যেমন আত্মার নিভৃত আত্মকথন, অন্যদিকে তেমনই সমকালীন যুগের অমোঘ দর্পণ।

ব্যক্তি ও সমাজ—এই দুটি ধারণা পরস্পরবিরোধী আবার পরস্পর-অনুপ্রাণিত; তাদের মধ্যকার এই নিত্যনৈমিত্তিক দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ই সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতার প্রাণবস্তু, তার অস্তিত্বেরই নির্যাস।

বাংলা সাহিত্যের আদ্যপর্বে, মধ্যযুগীয় ভক্তি কবিতায় ব্যক্তি প্রধানত আত্মনিবেদিত এক ভক্ত। চণ্ডীদাসের কণ্ঠে আমরা শুনি, “শুন হে মানুষ ভাই / সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” এই পঙ্ক্তি কেবল আধ্যাত্মিক সত্য নয়; এটি তার সমকালীন বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজের কঠোর কাঠামোর বিরুদ্ধে এক সুস্পষ্ট, যদিও নম্র, বিদ্রোহের আওয়াজ। ব্যক্তি এখানে ঈশ্বরের সঙ্গে নিজের একান্ত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে সামাজিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়ান। একইভাবে বিদ্যাপতির রাধা-কৃষ্ণের রূপক-আবরণে প্রকাশ পেয়েছে মানবীয় প্রেম, বিরহ ও কামনার এমন এক চিত্র, যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিকে অন্তঃসলিলাভাবে অতিক্রম করার প্রয়াস পায়। এই পদাবলি কবিতাগুলোতে ব্যক্তিগত প্রেমের তীব্রতা সামাজিক বাঁধনকে অতিক্রম করার এক স্বর্গীয় অনুমতি পেয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু এটিও লক্ষণীয় যে, এই বিদ্রোহ সরাসরি নয়; এটি রূপকের আড়ালে আবৃত, যা সেই সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটকেই নির্দেশ করে। সাহিত্যতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, রোম্যান্টিক সমালোচকদের মতে, এই ভক্তি কবিতাগুলোতে ব্যক্তির সঙ্গে ঐশ্বরিকের সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম (যেমন পুরোহিত) এর প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে, যা একটি বিপ্লবী চিন্তাই বটে।

বাংলার নবজাগরণের যুগে এসে আমরা পাই মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ তিনি রামায়ণের প্রচলিত আখ্যানকে উল্টে দিয়ে রাবণ ও মেঘনাদের চরিত্রে মডেল করেন ট্র্যাজিক নায়কের। এখানে ব্যক্তির অহংকার, গরিমা, বীরত্ব ও পরাজয়ের মাধ্যমে ফুটে ওঠে এক নতুন ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, যা পুরাণ ও সমাজ-নির্ধারিত নীতিবোধকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়। মধুসূদনের এই সাহসী পদক্ষেপ কেবল একটি সাহিত্যিক বিপ্লবই নয়, এটি ছিল সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা ও তার স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের প্রতি এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। নব্য-ঐতিহাসিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, মধুসূদনের এই সৃষ্টি কেবল সাহিত্যিক সৃজনশীলতা নয়, বরং ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজে উদীয়মান বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরই প্রকাশ, যেখানে ব্যক্তি ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে।

অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে এই দ্বৈততাকে এক নতুন মাত্রা দেন। ‘সোনার তরী’ বা ‘বলাকা’ কাব্যের কবিতাগুলোয় ব্যক্তি আত্মার একাকী যাত্রা, সৌন্দর্যের সন্ধান ও অস্তিত্বের গূঢ় অর্থান্বেষণের কথা বলে। কিন্তু এই একাকী পথিকই আবার ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় সমাজের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা ঔপনিবেশিক শক্তির বর্বরতার বিরুদ্ধে এক বিশ্বজনীন মানবিক প্রতিবাদ, যেখানে ব্যক্তিগত বিবেকই হয়ে ওঠে সমগ্র মানবসমাজের বিবেক। তিনি দেখিয়েছিলেন, ব্যক্তির আত্মিক মুক্তি ও সমাজের মুক্তি দুইটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। গবেষক এডওয়ার্ড সাইদের 'প্রাচ্যবাদ' তত্ত্বের আলোকে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি একটি উপনিবেশিত ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লেখা, যা ইউরোপের স্ব-ঘোষিত 'সভ্যতা'বাহকের মুখোশ খুলে দেয়। একইসাথে, একজন মানবতাবাদী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন সার্বজনীন মানবতাবাদে, যা তার কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ককে একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত দান করে।

এই সময়কালেই ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক কবিরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন এক নতুন মাত্রায়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর ‘টিন্টার্ন অ্যাবে’ (Tintern Abbey) কবিতায় প্রকৃতির মাঝে ডুবে থেকে ব্যক্তির তার অন্তর্নিহিত আত্মাকে উপলব্ধি এবং সমাজের ‘দুর্বহ গুরুভার’ থেকে মুক্তি লাভের কথা বলেছেন।

"For I have learned to look on nature, not as in the hour of thoughtless youth; but hearing oftentimes the still, sad music of humanity."

এটি ছিল শিল্পায়নোত্তর সমাজের যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের আত্মপলায়ন, যেখানে ব্যক্তি নিজের ভেতরেই খুঁজে পায় শান্তি ও অর্থ। জাঁ জাক রুসোর 'উদাত্ত বর্বর' তত্ত্বের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে, যেখানে সভ্যতা মানুষকে তার সহজাত পবিত্রতা থেকে বিচ্যুত করেছে বলে মনে করা হয়।

লর্ড বায়রনের ‘বায়রোনিক নায়ক’ হল সেই বিদ্রোহী, রহস্যময়, সমাজ-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আদর্শরূপ, যার ট্র্যাজেডি তাকে মহিমান্বিত করে।

"I stood among them, but not of them; in a shroud of thoughts which were not their thoughts."

এই চরিত্রের মাধ্যমে বায়রন বলতে চেয়েছেন যে, সমাজের রীতিনীতি অনেক সময় ব্যক্তির মহত্ত্বকে মেনে নিতে পারে না, ফলে সেই ব্যক্তির ট্র্যাজেডি অনিবার্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে উইলিয়াম ব্লেক তাঁর ‘নির্দোষতা ও অভিজ্ঞতার গান’-এ শিল্পবিপ্লব-উত্তর ইংল্যান্ডের কদর্য রূপ তুলে ধরেন। ‘চিমনি সুইপ’ (The Chimney Sweeper) কবিতায় এক শিশু শ্রমিকের করুণ কাহিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সামাজিক ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচিত করে।

"Because I was happy upon the heath, And smil'd among the winter's snow, They clothed me in the clothes of death, And taught me to sing the notes of woe."

ব্লেকের কবিতা প্রমাণ করে যে, ব্যক্তির দুঃখগাথাই যখন কবিতার ভাষা পায়, তখন তা সমগ্র সমাজের কাছে এক জ্বলন্ত অভিযোগে পরিণত হয়। মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে, ব্লেকের কবিতা শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর বিচ্ছিন্নতাকে চিত্রিত করে, যেখানে শিশু শ্রমিকটি তার শ্রমের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সে একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বলি।

এছাড়াও, আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'লিভস অব গ্রাস' (Leaves of Grass) কাব্যগ্রন্থটি এই যুগেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্রের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি করে। তাঁর 'আমার নিজের গান' (Song of Myself) কবিতায় "আমি নিজেকে উদযাপন করি, নিজের গান গাই" বলার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তির মহিমা ঘোষণা করেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলেন "কারণ আমার অন্তর্গত প্রতিটি পরমাণু তোমার জন্যও সমান ভালো।" এটি ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক, জৈব সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা করে, যা রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, আধুনিক নগরসভ্যতার বিস্তার ও মানবমনের জটিলতার প্রকাশ ঘটতে থাকে কবিতায়। বাংলায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এ সময়ের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ঘোষণা। “বল বীর – / বল উন্নত মম শির!”—এই ‘আমি’ বা ব্যক্তি শুধু সমাজ বা রাজার নয়, সে নিয়তি, প্রকৃতির বিরুদ্ধেও দাঁড়ানোর দৃঢ়তা রাখে। এটি ছিল ব্যক্তিমনের অফুরন্ত শক্তির এক মহাকাব্যিক আত্মপ্রকাশ, যা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধঘোষণা। নজরুলের বিদ্রোহ কেবল ধ্বংসের বিদ্রোহ নয়, এটি ছিল নতুন সৃষ্টিরও দিশারী। তাঁর ‘কামাল পাশা’ বা ‘আনোয়ার’ এর মতো কবিতায় এই ব্যক্তির বিদ্রোহী চেতনাই সমষ্টির মুক্তির পথ দেখাতে শুরু করে। তিনি ব্যক্তির শক্তিকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছিলেন। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, নজরুলের 'নারীর রূপ' বা 'বিদ্রোহী' কবিতায় নারীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করা যায়। তিনি নারীকে দেবী ও ভোগ্যবস্তুর traditional image থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে একজন সঙ্গিনী, মাতা এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে দেখেছেন, যা সেই সময়ের সমাজে একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

কিন্তু নজরুলের এই সক্রিয়, বহির্মুখী বিদ্রোহের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন জীবনানন্দ দাস। তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতার সেই অমর পঙ্ক্তি, “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, / মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;”—এটি কোনো বাহ্যিক বিদ্রোহ নয়, বরং এক গভীর হতাশা, বিচ্ছিন্নতা ও অতীতের জন্য এক মর্মমূলী আকুতি। আধুনিক নগর জীবনের যান্ত্রিকতা ও অর্থহীনতা থেকে পালিয়ে ব্যক্তি এখানে এক নিভৃত, কাল্পনিক আশ্রয় খোঁজে। জীবনানন্দের কবিতায় ব্যক্তি সমাজ থেকে সরে এসে নিজেরই ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। তবে তাঁর এই ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে সমাজবিচ্ছিন্ন নন; ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতাগুলোয় এই নিসঙ্গ ব্যক্তিই বাংলার গ্রাম্য জীবন, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনাই তাকে সমাজের সঙ্গে আরও গভীর এক আত্মিক সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলে। অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে জীবনানন্দের কবিতাকে পড়া যায়, যেখানে ব্যক্তি এই বিশ্বে 'নিক্ষিপ্ত' এবং তার অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পেতে সংগ্রামরত। তাঁর কবিতার নৈরাশ্য ও বেদনা আধুনিক মানুষের অস্তিত্বগত উদ্বেগেরই প্রকাশ।

এই সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন হলেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত প্রেম ও কামনার জটিলতা এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যা তখনকার রক্ষণশীল বাংলা সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ব্যক্তির সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, 'ব্যক্তিগত' অনুভূতিকে তিনি কবিতার বিষয়বস্তুতে পরিণত করে এক ধরনের সাহিত্যিক সাহসিকতার পরিচয় দেন।

এই আধুনিক বিচ্ছিন্নতার এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তি আমরা দেখি টি. এস. এলিয়টের ‘জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমের গান’-এ (The Love Song of J. Alfred Prufrock)। প্রথম লাইন থেকেই এক ধরনের অকার্যকরতা, অসাড়তা ও ভীতির আবহ তৈরি হয়।

"Let us go then, you and I, When the evening is spread out against the sky Like a patient etherized upon a table;"


নাগরিক সমাজের ড্রয়িং-রুমের আলাপচারিতা, বিচার-বিবেচনা এই ব্যক্তিকে গ্রাস করে ফেলেছে। "আমি কি সাহস করব মহাবিশ্বকে বিচলিত করতে?"—এই প্রশ্নটি আধুনিক মানুষের মনের গভীর হীনমন্যতা ও সামাজিক ভীতির প্রতীক। এলিয়টের ব্যক্তি নজরুলের বিদ্রোহী নায়কের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত; সে সমাজ দ্বারা এতটাই আক্রান্ত ও পর্যুদস্ত যে, তার পক্ষে কোনো ধরনের বিদ্রোহ বা পরিবর্তনের চিন্তা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি পুঁজিবাদী নগরসভ্যতার এক চরম নেতিবাচক দিককে তুলে ধরে। এলিয়ট নিজেই 'ঐতিহ্য ও ব্যক্তিগত প্রতিভা' প্রবন্ধে বলেছেন যে, কবির ব্যক্তিত্ব কাব্যে সরাসরি প্রকাশ্য হওয়া উচিত নয়, বরং তা বস্তুনিষ্ঠ সহসম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। 'প্রুফ্রক' এই তত্ত্বেরই সফল প্রয়োগ, যেখানে নগর-সভ্যতার বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যক্তির হতাশা একটি চিত্র, প্রতীক ও রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

একই সময়ে ফরাসি কবি চার্লস বোদলেয়ার তাঁর ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স অব ইভিল’ (The Flowers of Evil) কাব্যে আধুনিক প্যারিস শহরের ‘নরক’-কে চিত্রিত করেন। তিনি কদর্যতা ও পাপের ভেতর দিয়েই সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করতে চান। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি একইসাথে সমাজের দ্বারা বিকৃত ও মোহিত। স্পেনের ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার ‘জিপসি ব্যালাড’ (Gypsy Ballads) স্প্যানিশ সমাজের রক্ষণশীলতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জিপসি সম্প্রদায়ের স্বাধীনচেতা আত্মার এক জ্বলন্ত প্রতীকী বিদ্রোহ। এখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা সামগ্রিক সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। লোরকার কবিতায় ব্যক্তি যখন তার গিটার বাজায় অথবা গান গায়, তখন সে কেবল নিজের জন্য নয়, তার সম্পূর্ণ জাতির জন্য কথা বলে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে, নজরুলের সঙ্গীত ও কবিতার সঙ্গে লোরকার কবিতার একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়; উভয়েই ব্যক্তির কণ্ঠস্বরকে সমষ্টির কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রাশিয়ান কবি আন্না আখমাতোভাকে এই যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ হিসাবে উল্লেখ করতে হবে। স্তালিনের শাসনামলে, 'রেকুইয়েম' (Requiem) কাব্যগ্রন্থে তিনি ব্যক্তিগত মাতৃত্বের বেদনা (তার ছেলেকে গ্রেফতারের ঘটনা) এবং একটি সমগ্র জাতির সমষ্টিগত আঘাতকে একসাথে বেঁধে দিয়েছেন।

"No, not under the vault of alien skies... But right here, in the blurred ring of my own people, I have stayed and shared their common fate."

এই লাইনগুলোতে ব্যক্তি (আখমাতোভা নিজে) এবং সমাজ (রাশিয়ান জনগণ) এর যন্ত্রণা একাকার হয়ে গেছে। এটি 'ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক'-এর এক মর্মস্পর্শী দলিল।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়টি ছিল যুদ্ধ, বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক অগ্নিগর্ভ যুগ, যেখানে কবিতাকে সরাসরি সমাজ ও রাজনীতির অঙ্গনে নামতে হয়েছিল। এই সময়ে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়—ব্যক্তি এখানে শুধু বিচ্ছিন্ন সত্তা নন, বরং তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের সক্রিয় এজেন্ট, যার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও পরিচয় জাতীয় সংকটের মুখে সমষ্টির সঙ্গে মিশে যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবিতায় এক নতুন বাস্তববাদী ধারার সূচনা করে। উইল্ফ্রেড ওয়েনের 'ডালসে এট ডেকোরাম এস্ট' (Dulce et Decorum Est) কবিতায় যুদ্ধের 'গৌরবময় মৃত্যুর' প্রচলিত ধারণাকে চূর্ণ করে দেয়।

"Bent double, like old beggars under sacks, Knock-kneed, coughing like hags, we cursed through sludge... If you could hear, at every jolt, the blood Come gargling from the froth-corrupted lungs,"

ওয়েনের কাব্যতাত্ত্বিক অবস্থান ছিল স্পষ্ট। এই দর্শন তাকে যুদ্ধবাস্তবতার এমন মর্মস্পর্শী চিত্রণে পরিচালিত করেছিল যা যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সমাজের চেতনাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল।

জার্মানির বের্টোল্ট ব্রেখ্ট তাঁর 'যুদ্ধের প্রাইমার' (War Primer) কাব্যগ্রন্থে ফটোগ্রাফ ও কবিতার সমন্বয়ে এক নতুন ধরনের যুদ্ধবিরোধী काव्यभाषা সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর 'চিহ্ন মুছে ফেল!' (Erase the Traces!) কবিতায় ব্রেখ্টের 'দূরত্বকরণ প্রভাব' তত্ত্ব কবিতায় প্রয়োগ করে তিনি পাঠককে কাব্যিক আবেগে ডুবে যেতে দেননি, বরং একটি সমালোচনামূলক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করেছিলেন, যাতে তারা যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলো নিয়ে ভাবতে পারে।

লাতিন আমেরিকার কাব্যজগতে পাবলো নেরুদার 'সাধারণ সঙ্গীত' (Canto General) মহাকাব্যটি ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্কের এক যুগান্তকারী দলিল। তাঁর 'মাচু পিচ্চুর উচ্চভূমি' (The Heights of Macchu Picchu) কবিতায় নেরুদার 'অ-মৌলিক কবিতা' তত্ত্ব জীবনের সমস্ত জটিলতা, রাজনীতি ও ইতিহাসকে কবিতায় ধারণ করতে চেয়েছিল, যেখানে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। তাঁর 'আমি কয়েকটি বিষয় ব্যাখ্যা করি' (I Explain a Few Things) কবিতায় এই প্রশ্নব্যাঞ্জক বক্তব্য গৃহযুদ্ধের বিভীষিকার মুখে কবিতার সৌন্দর্যবোধের রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ব্যক্তি ও জাতির সম্পর্ক এক অনন্য মাত্রা পায়। তাঁর 'আইডেন্টিটি কার্ড' (Identity Card) কবিতায় দারবিশের কাব্যতত্ত্বে 'স্থান' একটি কেন্দ্রীয় ধারণা; ব্যক্তি তার জন্মভূমির সঙ্গে যে সম্পর্ক হারিয়েছে, তার শোক ও আকাঙ্ক্ষাই দারবিশের কবিতার প্রাণ হয়ে উঠেছে।

উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক এক গভীর মানবিক মাত্রা পেয়েছে। তাঁর 'মুকালামা' (সংলাপ) কবিতায় ব্যক্তিগত প্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। ফয়েজের এই কবিতায় ব্যক্তি এক দুরূহ দ্বিধার সম্মুখীন—একদিকে তার ব্যক্তিগত সুখ ও প্রেম, অন্যদিকে সমাজের প্রতি দায়িত্ব। ফয়েজের কবিতায় ব্যক্তি কখনোই সম্পূর্ণভাবে সমষ্টিতে বিলীন হয় না, বরং তার ব্যক্তিগত বিবেক ও নৈতিক অবস্থানই তাকে সমষ্টির নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা দেয়।

ফয়েজের  Subh-e-Azadi / Dawn of Freedom কবিতায় তিনি লিখেছেন: "আমরা পৃথিবীর বেদনার পথে হাঁটছি/কিন্তু আমাদের পথ আলাদা"। এই 'আমরা' এবং 'আমাদের পথ'-এর ধারণা ফয়েজের কবিতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে, যেখানে ব্যক্তি সমষ্টির অংশ হয়েও তার স্বতন্ত্র পথ অনুসরণ করে।

হিন্দি কবি কেদারনাথ সিংয়ের 'বাদল ধানের মরুভূমি' (Baadal Dhān kā Marusthal) কবিতায় সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান চিত্রিত করেছেন। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি প্রায়শই প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। কেদারনাথ সিং এর কবিতায় ভারতীয় গ্রামীণ জীবন ও নাগরিক জীবনের সংঘাতের মধ্যে ব্যক্তির আত্মানুসন্ধানের চিত্র ফুটে উঠেছে।

মরাঠি কবি কুসুমাগ্রজের 'বিষ' (Vish / Poison) কবিতায় সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ব্যক্তির প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় ভারতীয় সমাজের বর্ণপ্রথা ও শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যক্তির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুসুমাগ্রজের কবিতায় ব্যক্তি শুধু প্রতিবাদী নন, তিনি একইসাথে সমাজ পরিবর্তনের কারিগর। এছাড়াও মালয়ালম কবি কুমারনাশানের 'সন্ন্যাসী' (The Ascetic) কবিতায় আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ব্যক্তির অবস্থান নিয়ে গভীর চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কবিতায় ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য ও আধুনিক সমাজচেতনার সমন্বয় ঘটেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলা কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কে এক গুণগত পরিবর্তন এনেছিল। শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতায় ব্যক্তির জন্য স্বাধীনতার অর্থ খুবই ব্যক্তিগত ও মূর্ত। এখানে জাতীয় মুক্তির বিমূর্ত ধারণা ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের বস্তুগত বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কবিতায় এই উচ্চারণে ব্যক্তির যন্ত্রণা বিশ্বমানবতার বিবেকে ধিক্কার দেয়।

হাসান হাফিজুর রহমানের 'একুশে ফেব্রুয়ারি' কবিতায় ব্যক্তির স্মৃতিকে সমষ্টির স্মৃতিতে রূপান্তরিত করেছে। এই কবিতায় 'আমি' শুধু কবি নন, তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির প্রতিনিধি। অন্যদিকে সিকান্দার আবু জাফরের 'বারুদ ঘনিয়ে এলো' কবিতায় ব্যক্তির ভয় ও সংকট সমগ্র জাতির সংকটে পরিণত হয়েছে। এই 'আমি' বাংলাদেশের সবার প্রতিনিধিত্ব করে। জাফরের কবিতায় ব্যক্তির দুর্বলতা ও ভয়কে অস্বীকার না করে বরং তা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সমষ্টিগত সংগ্রামের শক্তি খুঁজে পাওয়ার একটি দর্শন কাজ করে।
আল মাহমুদের'১৯৭১ সালের স্বাধীনতা'কবিতায় আমরা ব্যক্তির আনন্দের সঙ্গে জাতীয় বিজয়ের মিশেল দেখি। এই কবিতায় ব্যক্তির মুক্তির অনুভূতি জাতীয় মুক্তির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন কবিতায় গভীর প্রভাব ফেলে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব' কবিতায় আমরা ব্যক্তির একটি anarchic বিদ্রোহ দেখি, যা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সব রকম বয়নকে অস্বীকার করে। শক্তির কবিতায় ব্যক্তি সমাজ থেকে সরে এসে এক ধরনের ব্যক্তিগত মুক্তির সন্ধান করে, যা নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতা-পরবর্তী হতাশার প্রতিফলন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীরা, আর কতকাল থাকব' কবিতায় ব্যক্তিগত প্রেমের যাত্রা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক যাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সুনীলের কবিতায় 'ব্যক্তি' প্রায়শই একজন শহরের পথচারী, যে তার চারপাশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি পর্যবেক্ষণ করে এবং শোষণ করে।

মুক্তিযুদ্ধের উপর বাংলাদেশের নারী কবিদের কবিতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্কে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। সেলিনা হোসেনের 'মুক্তিযুদ্ধের কবিতা'গুলোতে নারী-ব্যক্তির দ্বৈত ভূমিকা ফুটে উঠেছে—সে একদিকে যোদ্ধা, অন্যদিকে মা, যার ব্যক্তিগত ত্যাগ জাতীয় মুক্তির সঙ্গে যুক্ত। মালিহা খাতুনের 'একাত্তরের নারী' কবিতায় নারী-ব্যক্তির শরীর ও মন যুদ্ধের ট্রমা বহন করে, কিন্তু তবুও সে সহনশীলতা দেখায়।

পশ্চিমবঙ্গের কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের 'কস্তুরী গন্ধ' কবিতায় নারী-ব্যক্তির যৌনতা ও কামনাকে রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর কবিতায় 'ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক' এই নারীবাদী স্লোগানের সফল প্রয়োগ ঘটে। মল্লিকা যুদ্ধ ও বিপ্লবের আলোচনায় নারীদেহ ও মনোজগতকে কেন্দ্রীয় স্থান দেন।

ইতালীয় কবি ও দার্শনিক আলবা দে সেসপেদেসের 'বিপ্লব' (Rivoluzione) কবিতায় নারী-ব্যক্তির রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতায় নারী-ব্যক্তি সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে আলোচনামূলক প্রতিরোধে স্থানান্তরিত হয়। অপরদিকে মেক্সিকান কবি রোসারিও কাস্তেলানোসের 'নারী যে নিজেকে চেনে' (La Mujer que Sabe de Sí) কবিতায় নারী-ব্যক্তির আত্ম-উদ্ঘাটনকে রাজনৈতিক অঙ্গীকারে রূপান্তরিত করা হয়েছে।


চীনা সাহিত্যে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কের একটি সমৃদ্ধ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন চীনা কবি লি বাই (李白) তাঁর কবিতায় ব্যক্তির মুক্তচেতা ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। তাঁর 'মদ পান করে পাহাড়ি চাঁদের সাথে একা' কবিতায় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে ব্যক্তির আত্মিক মুক্তির চিত্র ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে, তাং যুগের কবি ডু ফু (杜甫) তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে সমগ্র সমাজের যন্ত্রণাকে চিত্রিত করেছেন। তাঁর 'স্প্রিং ভিউ' (春望) কবিতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজের করুণ চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেখানে ব্যক্তির দুঃখ সমষ্টির দুঃখে পরিণত হয়েছে।

আধুনিক চীনা সাহিত্যে লু জুনের 'একটি পাগল মানুষের ডায়েরী' (A Madman's Diary) গল্পটি সমাজের নিষ্ঠুরতা থেকে ব্যক্তির পাগল হয়ে যাওয়ার কাহিনী, যা চীনা সমাজের গভীর সমালোচনা। মাও যুগের কবি গু চেং তাঁর কবিতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব চিত্রিত করেছেন। সমসাময়িক চীনা কবি বেই দাওর 'প্রাচীন মন্দির' (Ancient Temple) কবিতায় চীনা সমাজের দ্রুত পরিবর্তনশীলতার মধ্যে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার চিত্র ফুটে উঠেছে।


তুর্কি সাহিত্যে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উসমানীয় যুগের কবি ইয়ুনুস এমরে তাঁর সুফি কবিতায় ব্যক্তির আত্মার সাথে divine-এর সম্পর্কের মাধ্যমে সামাজিক বিভেদ অতিক্রমের বার্তা দিয়েছেন। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের সময়কালে, নাজিম হিকমতের কবিতায় ব্যক্তির মুক্তির সাথে জাতীয় মুক্তির সম্পর্ক অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর 'সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র' (The Most Beautiful Sea) কবিতায় কারাগারে বন্দী একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা সমগ্র তুর্কি জাতির মুক্তির সাথে যুক্ত হয়েছে।

আধুনিক তুর্কি কবি ওরহান পামুক তাঁর উপন্যাসে যেমন, তেমনি তাঁর কবিতায়ও আধুনিক তুর্কি সমাজে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ও পরিচয় সংকট চিত্রিত করেছেন। তাঁর রচনায় পশ্চিমা ও ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যে দোদুল্যমান তুর্কি সমাজে ব্যক্তির অবস্থান ফুটে উঠেছে। তুর্কি কবি ফুরুজান তাঁর 'ইস্তাম্বুলের রাত্রি' (Istanbul Night) কবিতায় নগর জীবনে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কন করেছেন।

উত্তর-আধুনিক যুগে এসে রাজনৈতিক কবিতায় ব্যক্তির ভূমিকা আবারও পরিবর্তিত হয়। আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের 'চিত্কার' (Howl) কবিতা ব্যক্তিগত পাগলামিকে সমষ্টিগত সামাজিক সমালোচনায় রূপান্তরিত করে।

"I saw the best minds of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked..."

বাংলাদেশের সমকালীন কবি শামসুর রাহমান এর 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' কবিতায় আমরা  বিচ্ছিন্নতার এক চিত্র দেখি। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি নিজেকে এক বিচ্ছিন্ন, প্রায় ভূত-সদৃশ অস্তিত্ব হিসেবে আবিষ্কার করে।

বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যের প্রান্তর পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় একটিই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে—কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক একটি চিরন্তন, গতিশীল ও অপরিহার্য দ্বৈততা। এই সম্পর্ক কখনো সংঘাতপূর্ণ, কখনো সমন্বয়ধর্মী, কখনো নির্ভরশীল। চণ্ডীদাসের ‘মানুষ সত্য’-এর আধ্যাত্মিক ডাক থেকে নেরুদার ‘সাধারণ সঙ্গীত’-এর গণজাগরণের গান পর্যন্ত, জীবনানন্দের নিঃসঙ্গ ‘বনলতা সেন’ থেকে এলিয়টের অক্ষম ‘প্রুফ্রক’ পর্যন্ত, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ থেকে প্লাথের বিদীর্ণ ‘আরিয়েল’ পর্যন্ত—একটি অখণ্ড সূত্র কাজ করে। তা হল ব্যক্তির আত্মসন্ধান যা সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার দ্বন্দ্ব।

এই দ্বন্দ্ব একটি সার্বজনীন সাহিত্যিক থিম হলেও, এর অভিব্যক্তি সর্বদাই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। একটি বাংলা গ্রামের কৃষকের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি এবং একজন আধুনিক প্যারিসবাসীর বিচ্ছিন্নতা মূলগতভাবে একই মানবীয় অনুভূতিরই ভিন্ন রূপমাত্র। কবিতা, তার শিল্পিত শক্তিবলে, এই ব্যক্তিগত অনুভূতিকেই সার্বজনীনতার এবং স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে বিশ্বজনীনতার মর্যাদা দান করে। কবিতা হল সেই অনন্য ক্ষেত্র যেখানে ব্যক্তির একান্ত 'আমি' সমষ্টির 'আমরা'-র সঙ্গে মিলিত হয়ে এক নতুন, সর্বজনীন সুরের জন্ম দেয়—একটি এমন সুর যা কখনো বিরতিহীন, চিরন্তন।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া, ঢাকা।

১৩৮ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
এলাকার খবর

বিজ্ঞাপন

৩০০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ সব খবর
সাহিত্য নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন