জিয়াউর রহমানের গণভোট: ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা ও বর্তমান রাজনৈতিক সংকট
বৃহস্পতিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৫ ২:২৮ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনকে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করতে গেলে ইতিহাসের সঠিক পাঠ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতি নির্ধারকদের অস্পষ্ট অবস্থান, দ্ব্যর্থক বক্তব্য এবং অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করছে যে নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা। এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যেই জামায়াত ইসলামী, এনসিপি সহ কিছু রাজনৈতিক দল হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে গণভোটের দাবি তুলে ৩০ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেছেন। তাদের যুক্তি, জুলাই জাতীয় সনদের টেকসই আইনিভিত্তি নিশ্চিত করতে নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। গণভোটের এই দাবিকে সমর্থন করতে গিয়ে কিছু মহল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে অনুষ্ঠিত ১৯৭৭ সালের হ্যাঁ/না ভোটের উদাহরণ টানছেন, যা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, ঐতিহাসিক বিকৃতি ও অপ্রাসঙ্গিক। অন্যদিকে, বিএনপি-বিরোধী একটি মহল ইচ্ছাকৃতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছিলেন। এই উভয় বক্তব্যই ইতিহাসের বিকৃতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসের misuse-এর চেষ্টা মাত্র।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ/না ভোট ছিল একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ফল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশ যখন গভীর রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জাতীয় পুনর্গঠন, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্বহাল করার জন্য এই ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যালট পেপারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল: 'রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, বি.ইউ. এবং তাঁহার অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি আপনার আস্থা আছে কি? (হ্যাঁ অথবা না)'। এটি উল্লেখ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে জিয়াউর রহমান কখনোই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা দখলের জন্য আগ্রহী ছিলেন না, যা বর্তমান সময়ের কিছু রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। বরং দেশের সংকটময় পরিস্থিতিই তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করেছিল। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে যখন দেশ নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছিল, তখন তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম ছিলেন।
জিয়াউর রহমানের সময়কালে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা ফিরে আসে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করে গড়ে তোলেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন তা নয়, তিনি ১৫ আগস্ট-পরবর্তী অরাজকতা ও নৈরাজ্য থেকে দেশকে তিনি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসেন। তার সরলতা, সততা ও দেশপ্রেমের কারণে সাধারণ মানুষের সরকারের প্রতি আস্থা সুদৃঢ় হয়। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়, যা বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি।
বর্তমান পরিস্থিতির করুণ বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখছি। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে ভীতসন্ত্রস্ত, অনেকেই তাদের পুঁজি দেশ থেকে বের করে নিচ্ছেন। প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার গতিশীলতা ও কার্যকারিতা হারিয়েছে। সর্বোপরি, সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও ক্ষোভ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ এখন দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
জিয়াউর রহমানের সময়ে মানুষ তাঁর নেতৃত্বে থাকার জোরালো সমর্থন জানালেও, আজকের পরিস্থিতিতে মানুষ দ্রুত নির্বাচন চাইছে। তাই, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। জিয়াউর রহমানের সময়ের মতো সাফল্য অর্জন করতে চাইলে সরকারকে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কার্যকর ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিতে হবে। তখনকার নেতৃত্ব ছিল মূলত আদর্শভিত্তিক, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এবং জনগণের সেবায় নিবেদিত। অন্যদিকে, বর্তমান সময়ের অনেক রাজনীতিবিদ ক্ষমতাকেন্দ্রিক, সুযোগসন্ধানী এবং ব্যক্তিস্বার্থে মগ্ন। জিয়াউর রহমানের সময়কার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না বুঝে জিয়াউর রহমানের সময়ের সাথে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এই পার্থক্যগুলোই বর্তমান সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।
বর্তমান সরকারের উচিত ইতিহাসের বিকৃতি বা দোষারোপের রাজনীতি না করে জিয়াউর রহমানের মতো সৎ ও দেশপ্রেমিক নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা। জিয়াউর রহমানের সময়ের সাথে তুলনা করতে চাইলে তার মতো ভালো কাজ করে দেখানোর মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে না ইতিহাসের বিকৃতি বা অন্য দলের প্রতি দোষারোপের মাধ্যমে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করা। দেশবাসী এখন দ্রুত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, এই আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান দেখানো সময়ের দাবি।
সরকারের উচিত হবে:
১. দায়িত্বশীল আচরণ: রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট সমাধান
২. স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ
৩. জনগণের আস্থা অর্জন: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটার অধিকার নিশ্চিতকরণ
জিয়াউর রহমানের সময়ের সাথে তুলনা করতে চাইলে তার মতো ভালো কাজ করে দেখানোর মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব। ইতিহাসের সঠিক পাঠ নিয়ে আগামী দিনের পথ চলাই হবে বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
১২৩ বার পড়া হয়েছে