বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাঃ চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:১৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য। কিন্তু শুধু পেট ভরানোই শেষ কথা নয়- নিরাপদ, পুষ্টিকর ও মানসম্পন্ন খাদ্যই আজ মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার প্রধান ভিত্তি। খাদ্য এবং খাদ্যের নিরাপত্তা বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর ২০তম সাধারণ অধিবেশনে ১৯৭৯ সালে ১৬ অক্টোবরকে বিশ্ব খাদ্য দিবস ঘোষণা করে আর ২০১৮ সালে ৭ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক নিরাপদ খাদ্য দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ বছরের প্রতিপাদ্য- 'খাদ্যের মান, জীবনের নিরাপত্তা।' নিরাপদ খাদ্য কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের নয়, জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনীতি, কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা প্রশ্নটি এখন এক বহুমাত্রিক ইস্যু- উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ, পুষ্টি, ভেজাল এবং আইনগত প্রয়োগের সমন্বয় ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
১. খাদ্য নিরাপত্তার তত্ত্ব ও ধারণাঃ
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝানো হয় এমন একটি অবস্থা, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি যথেষ্ট, পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যে অবিরাম প্রবেশাধিকার রাখে।
FAO-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, খাদ্য নিরাপত্তার চারটি স্তম্ভ-
(১️) সহজলভ্যতা (Availability)
(২️) প্রাপ্তি (Accessibility)
(৩️) ব্যবহার বা পুষ্টিগুণ (Utilization)
(৪️) স্থিতিশীলতা (Stability)
খাদ্য নিরাপত্তার দর্শন মূলত মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ কেউ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে, কেউ যেন নিম্নমানের খাদ্যের কারণে অসুস্থ না হয়- এটাই খাদ্য নিরাপত্তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।
২. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: খাদ্যের নিরাপত্তাহীন পৃথিবীঃ
জাতিসংঘের The State of Food Security and Nutrition in the World 2024 প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় ৭৩.৫ কোটি মানুষ এখনও ক্ষুধার্ত, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯.১%। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় এই সংকট সবচেয়ে প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, কৃষি-উৎপাদনের পতন, এবং খাদ্যব্যবস্থায় বৈষম্য এই সংকটকে তীব্র করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর ৬০০ মিলিয়ন মানুষ দূষিত খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয় এবং প্রায় ৪,২০,০০০ মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ নিরাপদ খাদ্যের অভাব এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা: অগ্রগতি ও বাস্তবতাঃ
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। স্বাধীনতার পর খাদ্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন ছিল এক ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ আশ্চর্যজনক সাফল্য অর্জন করেছে।
- FAO (2023) রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী দেশ- বছরে গড়ে প্রায় ৩.৭ কোটি টন ধান উৎপাদিত হয়।
- দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালে ছিল ৫৬%, যা এখন ১৮.৭% (BBS, 2023)। প্রোটিন, ফলমূল ও শাকসবজির সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত ডিম, মাছ ও দুধের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো- এই উৎপাদনের সবটাই নিরাপদ নয়। শহর ও গ্রাম উভয় পর্যায়ে খাদ্যে ভেজাল, রাসায়নিক, সংরক্ষণজনিত ঝুঁকি এবং বাজার ব্যবস্থার অনিয়ম এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে।
৪. খাদ্যে ভেজাল ও জনস্বাস্থ্যঃ
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (DNCRP)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাজারে ৪৫% খাদ্যপণ্য কোনো না কোনোভাবে ভেজালের শিকার।
রাসায়নিক কীটনাশক, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, রঙ এবং সংরক্ষণে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ মানবদেহে ক্যান্সার, লিভার, কিডনি ও হরমোনজনিত সমস্যা সৃষ্টি করছে।
ICDDRB (2023) এর গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় বিক্রি হওয়া ৬৫% দুধে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে।
ফলে 'খাদ্য নিরাপত্তা' কেবল অর্থনৈতিক নয়, এখন জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ও নৈতিকতার সংকট।
৫. আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠানঃ
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন নীতি ও আইন:
খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩। জাতীয় খাদ্যনীতি ২০০৬। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA)। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯। BSTI মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছে এবং ৬,০০০টির বেশি জরিমানা আরোপ করেছে (সূত্র: BFSA Annual Report 2024)। তবে আইন প্রয়োগ ও শাস্তির অনিশ্চয়তা বড় সমস্যা।
৬. কৃষি ও প্রযুক্তির ভূমিকাঃ
ডিজিটাল কৃষি, জৈব চাষ, হাইব্রিড জাত এবং স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা এখন বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত খুলছে।
BRRI ও BINA-এর উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু, খরা-সহিষ্ণু ধান উপকূলীয় অঞ্চলে উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
এছাড়া 'আমার গ্রাম আমার বাজার', 'ই-চাষি অ্যাপ' এবং 'ডিজিটাল ফার্মিং প্ল্যাটফর্ম' কৃষককে সরাসরি বাজারে যুক্ত করছে, যা মধ্যস্বত্বভোগী নির্ভরতা কমিয়ে খাদ্যের সঠিক মূল্য ও মান নিশ্চিত করছে।
৭. জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যের ঝুঁকিঃ
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, চরাঞ্চল ও হাওর এলাকা এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভুক্তভোগী।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা ও বন্যা- এই চার বিপর্যয় সরাসরি কৃষিজ উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বব্যাংকের Climate Change and Food Security in Bangladesh (2024) প্রতিবেদনে বলা হয়-
'২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ধান উৎপাদন কমে যেতে পারে ১৭% পর্যন্ত।'
অতএব, খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষায় জলবায়ু সহনশীল কৃষি নীতি এখন সময়ের দাবি।
৮. পুষ্টি ও সামাজিক ন্যায্যতাঃ
খাদ্য নিরাপত্তা মানেই শুধু খাদ্য পাওয়া নয়, পুষ্টি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (BDHS 2022) অনুসারে,
৫ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং হার ২৮%
নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ৪১%
দৈনিক ফল ও সবজির গ্রহণ মানদণ্ডের নিচে রয়েছে প্রায় ৬০% মানুষ।
পুষ্টিহীনতা সরাসরি কর্মক্ষমতা, মেধা ও শিক্ষায় প্রভাব ফেলে- যা একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।
৯. নিরাপদ খাদ্যের জন্য নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্বঃ
খাদ্য নিরাপত্তা কেবল সরকারের দায় নয়; যা নাগরিক সচেতনতার অংশ। নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করে।
ভোক্তা হিসেবে আমাদের জানতে হবে-
কী কিনছি, কোথা থেকে কিনছি, কীভাবে সংরক্ষণ করছি।
বাজারে মাননিয়ন্ত্রণ চিহ্ন ও মেয়াদ যাচাই করা অভ্যাস করতে হবে।
স্কুল, কলেজ, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে খাদ্য সচেতনতা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে।
১০. ভবিষ্যৎ করণীয়ঃ
১️. কৃষিপণ্যের ট্রেসিং ব্যবস্থা চালু করা।
২️. খাদ্য পরীক্ষাগার সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ।
৩️. স্থানীয় সরকার পর্যায়ে খাদ্য সুরক্ষা কমিটি।
৪️. খাদ্যশিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি।
৫️. ক্ষুদ্র কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা।
খাদ্য শুধু শরীরের জ্বালানি নয়; সভ্যতার আত্মা। একটি জাতির নৈতিকতা ও ন্যায্যতা বিচার করা যায় তার খাদ্যব্যবস্থার পরিস্থিতি অবলোকনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ আজ উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে, কিন্তু নিরাপত্তা ও পুষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন মানবিক নীতি, কঠোর প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা।
নিরাপদ খাদ্য মানেই নিরাপদ ভবিষ্যৎ।
নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তায় আমাদের অঙ্গীকার প্রতিদিন। শুধু দিবস বিচারে বিচার্য নয় খাদ্য নিরাপত্তা সচেতনতা।এখন এটা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিত্যদিনের আন্দোলন। তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- সুস্থ জীবন, নিরাপদ খাদ্য, মানবিক বাংলাদেশ।
সূত্রসমূহঃ
১. জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO): বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা ২০২৪।
২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO): খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্যপত্র, ২০২৪।
৩. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS): বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩।
৪. বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (BFSA): বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৪।
৫. বিশ্বব্যাংক: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদন, ২০২৪।
৬. বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ (BDHS): ২০২২ সালের প্রতিবেদন।
৭. আইসিডিডিআরবি (ICDDRB): গবেষণা ফলাফল, ২০২৩।
লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
১৮১ বার পড়া হয়েছে