বাণিজ্য উপদেষ্টার বিদ্রুপ মন্তব্য!

বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫ ৫:০৭ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাণিজ্য উপদেষ্টা জনাব বশিরউদ্দিন সাহেবের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য গণমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ট্রেড ফেয়ারে বিএমটিএফ-এর স্টল পরিদর্শনকালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ফার্নিচার উৎপাদন নিয়ে যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন, তা প্রতিষ্ঠানটির অগ্রগতি ও জাতীয় প্রয়োজনায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য নয়, বরং একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। তার মতে, বিএমটিএফ-এর উচিত “ফার্নিচার না বানিয়ে ট্যাংক ও কামানের গোলা বানানো”। এমন মন্তব্য একটি প্রতিষ্ঠানের বহুমুখী সাফল্য ও অভিযোজনক্ষমতাকে অস্বীকার করার শামিল।
যেখানে বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা শিল্পের বহুমুখীকরণ চলছে সেখানে এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, একটি দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প কি কেবল যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই আমাদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি জেনারেল ডায়নামিক্স চিকিৎসা প্রযুক্তি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণেও জড়িত। ব্রিটেনের বিএই সিস্টেমস, একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানি, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বিপুল পরিমাণ পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (PPE) উৎপাদন করে জাতীয় সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্কের মতো দেশগুলোর প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বেসামরিক খাতে সফলভাবে বিনিয়োগ করছে। তারা বুঝেছে, একটি টেকসই ও লাভজনক প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে হলে বেসামরিক বাজারে প্রবেশ অপরিহার্য।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও বিএমটিএফ-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য। জনাব বশিরউদ্দিন কি ভেবে দেখেছেন, প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের সামরিক বাজেট কত সীমিত? একটি দুর্বল উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে কৌশলগত দিক থেকে চিন্তা করতে হয়। বিএমটিএফ এই চিন্তারই ফলশ্রুতি। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নেওয়ার পর এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের গভীর গহ্বর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ২০০১ সালে যার আয় ছিল নগণ্য, ২০২৪ অর্থবছরে তা পৌঁছেছে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকায়, যা আগের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি। এটি এখন বছরে ১০,০০০-এরও বেশি বাণিজ্যিক ও সামরিক যানবাহন সংযোজন ও সংস্কার করে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি ব্যাটারি, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক মিটার, প্যাকেজিং ও প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদন করে যা সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বহুমুখীকরণ শুধু আয় বাড়ায়নি, রাষ্ট্রকে রাজস্ব দিয়েছে এবং প্রায় ৩,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান, নিয়োগ দিয়ে হাজার হাজার মানুষের -এর আয়ের সংস্থান করছে।
শুধু তাই নয়, জাতীয় সংকটে বিএমটিএফ-এর ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করছে। যেমন, কোভিড-১৯ মহামারীর সময় বিএমটিএফ-এর স্যানিটাইজার উৎপাদন নিয়ে বশিরউদ্দিন সাহেবের বিদ্রূপ মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশজুড়ে যখন স্যানিটাইজারের acute shortage, তখন বিএমটিএফ তার কেমিক্যাল ডিভিশন ব্যবহার করে দ্রুত ১ লক্ষাধিক বোতল স্যানিটাইজার উৎপাদন ও সরবরাহ করেছিল, যা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এটি কোনও “লজ্জার কাজ” নয়, বরং একটি জাতীয় সংকটে একটি প্রতিষ্ঠানের দ্রুত সাড়া দেওয়া ও মানবিক দায়িত্ব পালনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি প্রমাণ করে বিএমটিএফ শুধু যান্ত্রিক পণ্য নয়, জাতির প্রয়োজনে জীবনরক্ষাকারী পণ্যও তৈরি করতে সক্ষম।
বশিরউদ্দিন সাহেবের বক্তব্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আত্মসম্মান ও পেশাদারিত্বকেও challenged করা হয়েছে। তিনি কি জানেন যে, বিএমটিএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের উপর তাদের আর্থিক burden কমিয়ে আনে? এটি একটি আধুনিক ও দায়িত্বশীল সামরিক বাহিনীর বৈশিষ্ট্য – যারা শুধু দেশরক্ষা নয়, জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। বিএমটিএফ-এর সাফল্য এই মডেলেরই প্রতিফলন, যা দেশের সম্পদ সাশ্রয় করে এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
বিএমটিএফ কোনও লজ্জার নাম নয়। এটি বাংলাদেশের সক্ষমতা, উদ্ভাবনী শক্তি ও শৃঙ্খলার একটি জীবন্ত প্রতীক। এটি প্রামন করে দেয় যে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানের এবং জাতীয় প্রয়োজনে তারা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। সমালোচনা না করে, বিএমটিএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের উৎসাহিত করা আমাদের national duty। বশিরউদ্দিন সাহেবের উচিত হবে এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও জাতীয় অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, এবং ভবিষ্যতে এমন productive প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সমর্থন জোরদার করা।
বিএমটিএফ বাংলাদেশের গর্ব – এটিকে অবজ্ঞা নয়, প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার সময় এখনই।
পরিশেষে বলবো, বশির এতোই সমালোচনা করার যেহেতু শখ আছে তাহলে —সাহস করে শেখ হাসিনার আমলে লক্ষ লক্ষ অন্যায় অনিয়ম হলো তখন কই ছিল আপনার এই সাহস? তখন কেন একটুও আওয়াজ করতে পারলেন না ? ওয়াকার সাহেবের মতো সবাইকে এতো ভদ্র ভাববেন না— এখনও সামরিক বনে অনেক বাঘ আছে —সময় মতো থাবা দিলে হুস থাকবে না।
লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক।
(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)
১৩৭ বার পড়া হয়েছে