সর্বশেষ

মতামত

গ্রামীণ নারীর শক্তিঃ সংগ্রাম, অর্জন ও ভবিষ্যতের পথ

স্বাধীন চৌধুরী
স্বাধীন চৌধুরী

বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:২২ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। এই দিবস বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অধিকার, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ দিন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬২/১৩৬ নম্বর রেজুলেশন (২০০৭) অনুযায়ী এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রেজুলেশনটির লক্ষ্য ছিল নারীদের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি দেওয়া।
বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীরা সমাজ ও অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। তাদের অবদান কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দারিদ্র্য, সামাজিক রীতি-নীতি, শিক্ষার অভাব এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের অবদান প্রায়শই কম মূল্যায়িত হয়।
এই প্রবন্ধে গ্রামীণ নারীর সংগ্রাম, অর্জন এবং ভবিষ্যতের পথ নিয়ে আলোচনা রাখছি। বিশেষভাবে এনজিও, কমিউনিটি ভিত্তিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হলো-

১. আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসের প্রেক্ষাপটঃ

আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আমাদের জানতে হবে, ২০০০-এর দশকে গ্রামীণ নারীদের অবদান এবং সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছিল।
জাতিসংঘের উদ্যোগ: ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ রেজুলেশন ৬২/১৩৬ পাশ করে। এতে বলা হয়, গ্রামীণ নারীরা খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কিন্তু তাদের অবদান প্রায়শই অবমূল্যায়িত হয়।

 

উদ্দেশ্য: নারীদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বিশ্বব্যাপী উদযাপন: আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, এবং স্থানীয় কমিউনিটি গ্রামীণ নারীদের অবদান স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবসটি ব্র্যাক, ইউএন উইমেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং স্থানীয় এনজিওগুলোর সহযোগিতায় পালিত হয়। তারা গ্রামীণ নারীদের উদ্যোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উদাহরণ তুলে ধরে।

২. গ্রামীণ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকাঃ

২.১ কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা:

বাংলাদেশের প্রায় ৬৫% মানুষ গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করে। এই অঞ্চলের নারীরা কৃষিতে অপরিসীম অবদান রাখেন। তারা ফসল বোনা, সেচ, নিড়ানি এবং ফসলের সংগ্রহে নিয়োজিত।
ক্ষুদ্র পশুপালন এবং মৎস্য চাষে অংশগ্রহণ করেন।

পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করেন।

 

কেস স্টাডি: ব্র্যাকের মাইক্রোফাইনান্স প্রোগ্রাম:
ব্র্যাকের মাইক্রোফাইনান্স প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া নারীরা ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তাদের ব্যবসা কৃষি, হস্তশিল্প, পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১.৮ মিলিয়ন নারী ব্র্যাকের মাইক্রোফাইনান্স সুবিধা গ্রহণ করেছেন, যার মাধ্যমে তাদের পরিবারের আয় গড়ে ২০%-৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

প্রভাব: এই কাজ নারীদের আত্মনির্ভরতা, পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সম্প্রদায়ে সামাজিক স্বীকৃতি বৃদ্ধি করে।

২.২ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ:

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি। বন্যা, নদী ভাঙন, লবণাক্তকরণ এবং সাইক্লোন গ্রামীণ নারী ও তাদের পরিবারকে প্রভাবিত করে।

গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা:

টেকসই কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়ন।
পানি সংরক্ষণ ও মাটি রক্ষার উদ্যোগ।
বন্যা সহনশীল ফসল চাষ।
কম্পোস্টিং এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার।

কেস স্টাডি: সাইফ এবং ইউএন উইমেন প্রকল্প:

সাইফ প্রোগ্রাম ও ইউএন উইমেনের সহযোগিতায় ৫০০ গ্রামের নারীরা স্থানীয় স্তরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন। তারা বন্যা সহনশীল ফসলের চাষ, পানি সংরক্ষণ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

প্রভাব: নারীরা কেবল পরিবেশ রক্ষা করছেন না, তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঝুঁকি হ্রাস এবং টেকসই জীবনধারার মডেল তৈরি করছেন।

২.৩ স্বাস্থ্যসেবা ও কমিউনিটি কেয়ার:

গ্রামীণ নারীরা কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মূল অবদান: মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্য।টিকা প্রচার।
পরিবার পরিকল্পনা ও পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা।

কেস স্টাডি: শুশীলার গল্প (উদাহরণ):
মুন্সীগঞ্জের গ্রামীণ এলাকার নারী স্বাস্থ্যকর্মী শুশীলা প্রতিদিন শতাধিক পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। শিশুর টিকা, মাতৃ স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি ২০০ পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।
প্রভাব: গ্রামীণ নারীরা স্বাস্থ্যসেবা বিতরণে মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছেন। তাদের উপস্থিতি রোগ প্রতিরোধ, শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হ্রাস এবং জনগোষ্ঠীর  স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।

২.৪ শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতায়ন:

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি।
বিভিন্ন এনজিও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
নারীরা শিশুদের শিক্ষায় সহায়তা করে।
কমিউনিটি উন্নয়ন কার্যক্রমে নেতৃত্ব গ্রহণ করে।
কেস স্টাডি: প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশনাল এক্সিলেন্স:
সংস্থাগুলো গ্রামীণ নারীদের সাক্ষরতা, কম্পিউটার দক্ষতা, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষার কোর্স প্রদান করছে। শিক্ষিত নারীরা শুধু পরিবারের উন্নয়ন নয়, কমিউনিটির সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছেন।

৩. চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতাঃ

গ্রামীণ নারীরা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, তা তাদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নকে সীমিত করে।

৩.১ দারিদ্র্য ও আর্থিক বৈষম্য:
কম বেতনের বা অবৈতনিক কাজে নিযুক্ত।
ব্যাংকিং, ঋণ এবং আর্থিক সেবা সীমিত।
উদ্যোক্তা হতে গেলে আর্থিক বাধা।
উদাহরণ- ব্র্যাকের মাইক্রোফাইনান্স ছাড়া অনেক নারী উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পান না।

৩.২ শিক্ষা ও দক্ষতা সীমাবদ্ধতা:
উচ্চশিক্ষার সুযোগ কম।
আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক দক্ষতা অর্জনে সীমাবদ্ধতা।

৩.৩ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা:
বাল্যবিবাহ, সামাজিক নিয়ম, এবং পরিবারের বাধ্যবাধকতা।
নারীদের স্বাধীন চলাচল ও পেশাগত সুযোগ সীমিত।

৩.৪ স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি:
স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সীমিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, দুর্যোগে ক্ষতি।

৪. অর্জন ও সফলতাঃ

৪.১ উদ্যোক্তা হিসেবে:
ক্ষুদ্র ব্যবসা ও হস্তশিল্পে সাফল্য।
আর্থিক স্বাবলম্বিতা। পরিবারের আয় বৃদ্ধি।
কেস স্টাডি: মাইক্রোফাইনান্স সফলতা:
ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, নারীদের ৪৫% ব্যবসা ১২ মাসের মধ্যে মুনাফা উৎপন্ন করছে।
গ্রামীণ নারীদের উদ্যোক্তা হওয়া জনগোষ্ঠীর  অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়ক।

৪.২ শিক্ষায় সাফল্য:
সাক্ষরতা বৃদ্ধি। কম্পিউটার ও ব্যবসায়িক দক্ষতা অর্জন। স্থানীয় নেতৃত্বে অংশগ্রহণ।

৪.৩ স্বাস্থ্যসেবায় অবদান:
কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য উন্নয়ন। পরিবার পরিকল্পনা ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি।

৪.৪ সমাজে নেতৃত্ব:
স্থানীয় কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে নেতৃত্ব।
সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা।

৫. ভবিষ্যতের পথঃ

৫.১ শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন:
নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার সুযোগ বৃদ্ধি। বয়স্ক নারীদের শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের সম্প্রসারণ।

৫.২ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি:
মাইক্রোফাইনান্স, ঋণ, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ।
আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন।

৫.৩ আইনি অধিকার নিশ্চিতকরণ:
জমির মালিকানা, উত্তরাধিকারের অধিকার।
কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্যোগ।

৫.৪ সামাজিক সচেতনতা:
নারীর অবদান ও অধিকার সম্পর্কে কমিউনিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি।
নারীর ক্ষমতায়ন সামাজিকভাবে সমর্থন করা।

৫.৫ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ:
স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, পুষ্টি ও পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলা।
টেকসই কৃষি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি এবং পরিবেশ সচেতনতা।

গ্রামীণ নারীরা বাংলাদেশের উন্নয়নে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উদ্যোক্তা এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
তাদের অবদান যথাযথ স্বীকৃতি, আর্থিক, সামাজিক এবং আইনি সহায়তা ছাড়া পূর্ণরূপে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন, অধিকার নিশ্চিত করা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করা জরুরি।

সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবেন এবং দেশের উন্নয়নে দৃঢ়ভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।

সূত্র সমূহঃ
1. UN. General Assembly Resolution 62/136
2. UN Women: Rural Women
3. BRAC Annual Report 2023
4. World Health Organization: Community Health Workers
5. IWMI: Women in Agriculture
6. UNDP Bangladesh
7. CPRD: Climate Change Adaptation

লেখকঃ কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

১৮৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন