অপব্যবহারের যুগে সাইবার সুরক্ষা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫ ৯:২৩ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২১শ শতাব্দীকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। আজ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক মানুষের হাতে একটি স্মার্টফোন, আর ইন্টারনেটের সংযোগ ছড়িয়ে গেছে ঘরে ঘরে। এই সংযোগের মাধ্যমে মানবসভ্যতা এক অভূতপূর্ব গতির যোগাযোগ, ব্যবসা, শিক্ষা ও জ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছে।
তবে প্রত্যেক প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সঙ্গে আসে একটি 'ছায়া'- সেই ছায়ার নাম এখন সাইবার অপরাধ ও তথ্যের অপব্যবহার। ফেসবুকের পোস্ট থেকে ব্যাংক একাউন্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য থেকে অনলাইন ভোটিং পর্যন্ত- সবই এখন তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় নির্ভরশীল। ফলে অপব্যবহার ও নিরাপত্তা দুটোই আমাদের প্রতিদিনের অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে-
আমরা কতটা নিরাপদ অনলাইনে?,
আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, অর্থ, চিন্তা ও মতপ্রকাশ কতটা সুরক্ষিত?,
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- সমাধান কোথায়?
তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ও নতুন বাস্তবতাঃ
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)-এর সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী (২০২৪), দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩.৬ কোটি। এর মধ্যে ৯০% এর বেশি ব্যবহারকারী মোবাইল ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া সরকারী সেবা যেমন মাইগভ, নগদ, বিকাশ, ই-পাসপোর্ট, ই-ট্যাক্স, অনলাইন ভোটার আইডি, ডিজিটাল ব্যাংকিং- সবকিছু আজ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। এই প্রযুক্তির সাফল্যের বিপরীতে বাস্তবতা হলো-
-অনলাইন প্রতারণা, হ্যাকিং, ফিশিং,
-ভুয়া তথ্য প্রচার, চরিত্রহনন,
-গুজব, মানহানি, সাইবার বুলিং,
-এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস-
সবকিছুই ক্রমবর্ধমান হারে ঘটছে।
বিশ্বব্যাপী INTERPOL Cybercrime Report 2024 অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে সাইবার অপরাধের আর্থিক ক্ষতি ছিল প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার- যা ২০২৫ সালের মধ্যে বেড়ে ১০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস। বাংলাদেশও এই সংকট থেকে মুক্ত নয়।
তথ্যের অপব্যবহার: এক বৈশ্বিক বিপর্যয়ঃ তথ্য এখন 'নতুন তেল'- অর্থাৎ সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যবসা, আবার একই তথ্য ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতারণা ও ক্ষমতা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে।
১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপব্যবহার
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউব- এই প্ল্যাটফর্মগুলো এখন কেবল যোগাযোগ নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের ক্ষেত্রও বটে।
অপব্যবহার দেখা যায় তিনভাবে-
(ক). ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও গুজব প্রচার: রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা বাণিজ্যিক লাভে।
(খ). ডিপফেইক প্রযুক্তি: কারও মুখ, কণ্ঠ, ছবি বিকৃত করে পর্নোগ্রাফি বা প্রতারণায় ব্যবহার।
(গ). সাইবার বুলিং ও মানসিক নির্যাতন: বিশেষ করে নারী ও কিশোরদের বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
UN Women Bangladesh (২০২৩) রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের ৭৫% নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কোনো না কোনোভাবে অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
২. আর্থিক প্রতারণা ও ডিজিটাল চুরি
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির (২০১৬) পর বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসে সাইবার নিরাপত্তা। এরপর থেকে ডিজিটাল লেনদেনে হ্যাকিং, স্ক্যাম ও ফিশিং ইমেইল একটি ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ইউনিট জানিয়েছে, শুধু মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে।
৩. তথ্য ফাঁস ও ডেটা ব্রিচ
সরকারি সার্ভার থেকে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়া এখন একটি বড় সংকট। ২০২৩ সালের একাধিক ঘটনায় জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেস হ্যাক করে নাগরিকদের তথ্য বিক্রি করা হয়েছে ডার্ক ওয়েবে।
এই ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
সাইবার অপরাধের ধরণ ও মনস্তত্ত্বঃ সাইবার অপরাধ শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকও।
অর্থলাভ: প্রতারণা বা র্যানসমওয়্যার।
প্রতিশোধ: সম্পর্কভিত্তিক বা রাজনৈতিক হ্যাকিং।
বিনোদন বা চ্যালেঞ্জ: অনেক তরুণ শুধুই 'কৌতূহল' থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
চিন্তার নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীভিত্তিক প্রোপাগান্ডা ও ভুয়া তথ্য প্রচার।
এই অপরাধগুলো মূলত 'ডিজিটাল অজ্ঞতা' ও 'নৈতিক অবক্ষয়'-এর ফসল।
সাইবার নিরাপত্তার সংকট: কেন আমরা দুর্বল
১. ডিজিটাল লিটারেসির অভাব: অনেক ব্যবহারকারী জানেই না কিভাবে তথ্য সুরক্ষিত রাখতে হয়।
২. দুর্বল পাসওয়ার্ড ও সফটওয়্যার: সহজে অনুমেয় পাসওয়ার্ড ও আপডেটহীন অ্যাপ।
৩. অপর্যাপ্ত সাইবার আইন বাস্তবায়ন: আইন থাকলেও কার্যকর প্রয়োগ সীমিত।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি: সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাইবার সিকিউরিটি টিমের সংখ্যা অপ্রতুল।
৫. নৈতিকতা ও সচেতনতার সংকট: ডিজিটাল নাগরিকত্বের চেতনা এখনো গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনি কাঠামোঃ
বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে প্রণয়ন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (Digital Security Act)। এর উদ্দেশ্য ছিল অনলাইন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, কিন্তু আইনটির অপপ্রয়োগ নিয়েও সমালোচনা ছিল।
২০২৩ সালে সরকার এটি সংস্কার করে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ নামে নতুন কাঠামো ঘোষণা করে।
এই আইনের মাধ্যমে-
হ্যাকিং, ডেটা চুরি, প্রতারণা, মানহানি, গুজব প্রচার ইত্যাদি অপরাধ হিসেবে গণ্য।
Bangladesh e-Government Computer Incident Response Team (BGD e-Gov CIRT) এবং Digital Security Agency (DSA)- এ দুটি প্রতিষ্ঠান এখন মূলত জাতীয় সাইবার সুরক্ষায় নিয়োজিত।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন যথেষ্ট হলেও বাস্তব প্রয়োগ, তদন্তের দক্ষতা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাইবার সুরক্ষাঃ
বিশ্বে এখন প্রতিটি রাষ্ট্রই সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র: ২০২৪ সালে 'Cybersecurity and Infrastructure Security Agency (CISA)' নতুন কৌশল গ্রহণ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন: GDPR (General Data Protection Regulation) এর মাধ্যমে তথ্যের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
ভারত: 'Cyber Surakshit Bharat' প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য এই উদ্যোগগুলো শিক্ষণীয় উদাহরণ।
করণীয় ও সমাধানের পথঃ
১. ব্যক্তিগত পর্যায়ে
জটিল ও নিরাপদ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
দুই স্তরের ভেরিফিকেশন (Two-Factor Authentication) চালু রাখুন।
সন্দেহজনক লিংক বা ইমেইল খুলবেন না।
শিশুদের অনলাইন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখবেন না।
২. সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা
পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে 'সাইবার এথিক্স' বা ডিজিটাল নৈতিকতা শিক্ষা চালু করতে হবে।
যেমন- কিশোরদের শেখাতে হবে অনলাইনে কিভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে গুজব বা প্রতারণা চেনা যায়।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
সরকারি সার্ভার ও ব্যাংকিং সিস্টেমে নিয়মিত নিরাপত্তা অডিট করা।
জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।
প্রতিটি সরকারি দপ্তরে সাইবার রেসপন্স টিম গঠন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি (INTERPOL, ITU, CERT)।
৪. প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন
AI ও মেশিন লার্নিং-নির্ভর ফ্রড ডিটেকশন সিস্টেম চালু করা।
ব্লকচেইন ও এনক্রিপশন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো।
ডেটা লোকালাইজেশন নিশ্চিত করে বিদেশে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জঃ
আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), Internet of Things (IoT), এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নতুন সাইবার ঝুঁকি তৈরি করবে।
উদাহরণস্বরূপ-
স্বচালিত গাড়ি হ্যাক হয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
স্মার্ট হোম ডিভাইস দিয়ে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
AI দিয়ে তৈরি ডিপফেইক ভিডিও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
অতএব, প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ততই স্মার্ট হতে হবে।
উপসংহারঃ
সাইবার জগৎ হলো এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র- যেখানে অস্ত্র হলো তথ্য, আর লক্ষ্য হলো মন ও অর্থ।
এই যুগে সাইবার নিরাপত্তা মানে কেবল প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ নয়, এটি নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত প্রস্তুতিও বটে।
আমাদের প্রতিটি নাগরিক, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে জানতে হবে-
'ডিজিটাল স্বাধীনতা' ও 'ডিজিটাল দায়িত্ব' একই মুদ্রার দুই পিঠ।
প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে হলে আমাদের দরকার সচেতন মন, জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যবহার, আর মানবিক বোধসম্পন্ন ডিজিটাল সংস্কৃতি।
সূত্রসমূহঃ
1. Bangladesh Telecommunication Regulatory Commission (BTRC), Internet Users Data 2024
2. INTERPOL Cybercrime Report 2024
3. UN Women Bangladesh, 'Online Gender-Based Violence Report', 2023
4. Bangladesh Police Cyber Crime Unit Annual Report 2024
5. Digital Security Agency (DSA), Government of Bangladesh, 2024
6. GDPR Regulation, European Union, 2023
7. Cybersecurity and Infrastructure Security Agency (CISA), USA, 2024
8. 'Cyber Surakshit Bharat', Ministry of Electronics & IT, India, 2024
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
১৫৫ বার পড়া হয়েছে