সর্বশেষ

মতামত

লাইব্রেরি ভাঙচুর : বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, পরিকল্পিত

মাসুদুল হাসান রনি
মাসুদুল হাসান রনি

শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৫:৫৬ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
গত শতাব্দীর সত্তরের শেষার্ধে আমার শৈশব ও কৈশোরের পুরো সময় ছিল পাড়া বা জেলার পাঠাগারমুখী। সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, জুল ভার্ন পড়তে পড়তে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা, মস্কোর প্রগতি প্রকাশনীর বাংলা অনুবাদে নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ইস্পাত, ননী ভৌমিকের সম্পাদনায় রুশ গল্প সংকলন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, ইউরি গ্যাগারিনের পৃথিবী দেখেছি, ফিওদর করডকিনের (হায়াৎ মাহমুদ অনূদিত) পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচীন যুগ (রাশিয়া)-এর মতো কঠিন কঠিন বই পড়া হয়ে গিয়েছিল।

এভাবেই পাঠাগার ও বই আমার শৈশব-কৈশোরে পৃথিবীকে জানার প্রবল আগ্রহ শুধু তৈরি করেনি, মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সমব্যথী হওয়া এবং সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ কী জানার আগ্রহ উসকে দিয়েছে। একারণেই বই ও পাঠাগারের প্রতি ভালোবাসাটা আজন্ম রয়ে গেল।

এখন আর পাড়া-মহল্লায় সেই পাঠাগার নেই। বইবিমুখ হয়েছে মানুষ। তারপরও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও ব্যক্তিপর্যায়ের কিছু উদ্যোগ রয়েছে, যা আশার আলো দেখায়। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে মানুষ দেশীয় সংস্কৃতি ও বইবিমুখ হয়েছে। সেখানে শিশু-কিশোরদের বইপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য এই কাজটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সারাদেশের জেলা, থানা ও স্কুল পর্যায়ে করতে পারলে ভালো হতো।

হঠাৎ এসব কথা কেন লিখছি?
কারণ তো অবশ্যই আছে।

শুক্রবার ছুটির দিন বেলা করে ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়ে অনলাইনে নিউজ স্ক্রল করে মন খারাপ হলো। সংবাদে এসেছে, ‘আওয়ামী লীগের দোসররা আড্ডা দেয়’ অভিযোগ তুলে উত্তরায় লাইব্রেরি ভাঙচুর।

কি অদ্ভুত—‘আওয়ামী লীগের দোসররা আড্ডা দেয়’ ট্যাগিং দিয়ে একটা লাইব্রেরি ভাঙচুর হলো, কেউ কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না। অবশ্য নিন্দা বা প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু হবে না। সরকার, প্রশাসন, জুলাইচেতনা বেচে খাওয়ারা সব জায়গায় আওয়ামী ভুত দেখেন। লাইব্রেরিতে ভুত দেখবেন—এটাই স্বাভাবিক। এর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক মৈত্রী’ ব্যানারে জড়ো হয়ে একদল ব্যক্তি ‘স্রোত আবৃত্তি সংসদের রবীন্দ্র স্মরণ দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান পণ্ড করে দিয়েছিল। মাজার ভাঙচুর, মন্দিরে হামলা, নারীদের খেলা বন্ধ করা, বসন্ত উৎসব ও ঘুড়ি উড়ানো, ভাস্কর্য ভাঙচুর, শো-রুম উদ্বোধনে তারকাদের বাধা দান, বইমেলায় বই বিক্রিতে বাধা প্রদান ও স্টল বন্ধ করে দেওয়া—এসব কোনোটা-ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সব কিছুর একটা যোগসূত্র আছে। সেটা রাজনৈতিক।

লাইব্রেরির দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেখানে সকল বর্ণ, ধর্ম ও বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ যায়। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, কে বাসদ-সিপিবি মতাদর্শের পাঠকের বেলায় রাজনৈতিক পরিচয় কোনোদিন কেউ দেখেনি। আপনারা বলুন, আওয়ামী সমর্থক বা তাদের পরিচিত কেউ হলেই তাকে বা তাদের দোসর বানিয়ে একটা লাইব্রেরি ভাঙচুর করা যায়?

আমার তো শত শত আওয়ামী বন্ধু আছে। অসংখ্য মন্ত্রী, সাংসদ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে পরিচয় ও নানান অনুষ্ঠানে ছবি আছে। আপনাদের চোখে আমি তাহলে আওয়ামী দোসর?

আপনি যা ইচ্ছে ভাবুন। আমার কিছু আসে যায় না।
আমি ব্যক্তির মতপ্রকাশ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। এমনকি আপনি যখন আক্রান্ত হবেন তখন আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি কথা বলব।

আমি যে সমাজে বেড়ে উঠেছি সেখানে সব দল, মত ও ধর্মের মানুষ ছিল। তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও সামাজিক সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু তা ছিল শ্রদ্ধা ও শালীনতার। এমনকি ছাত্রশিবিরের অনেক ছেলের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদের রাজনীতি নিয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছি। তারা শুনেছে, যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা ছিল রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারের মধ্যে।

গত চৌদ্দ মাসে মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সংস্কৃতিজন, শিক্ষক, নারী, আদিবাসীসহ সবাইকে ফ্যাসিস্টের দোসর বানিয়ে অপমান, অপদস্থ ও মবসন্ত্রাস করা হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে, এগুলো খুবই পরিকল্পিতভাবে করানো হয়েছে। সরকার ব্যর্থ হয়েছে মবসন্ত্রাস দমনে। এ দায় অবশ্যই তাদের বহন করতে হবে।

‘আওয়ামী দোসররা আড্ডা দেয়’ অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কের নেতৃত্বে যারা পাঠাগারে হামলা করেছে, এরা আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ভয় পায়। মানুষের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে উঠলে তার জানার আগ্রহ ও কৌতূহল বাড়ে। সে অজানাকে জানতে চায়। বিবেকবোধ জাগ্রত হয়, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন হয়। অন্যায়কে মেনে নেয় না। প্রতিবাদ করে। তাই শাসক ও অন্যায়কারীরা মানুষের পাঠাভ্যাসকে ভয় পায়। শাসক ও অন্যায়কারী জানে, বই মানুষকে সচেতন, সমালোচনামূলক এবং স্বাধীনচেতা করে তোলে। এতে তারা অন্ধ আনুগত্যের পরিবর্তে প্রশ্ন করতে শেখে, যা শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার জন্য হুমকি।

উত্তরার উন্মুক্ত লাইব্রেরি ভাঙচুর করার জন্য আওয়ামী দোসর-ফোসর অভিযোগ কিছু না। এটা একটা অজুহাত মাত্র। তাদের আসল ভয় হচ্ছে, বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন ধারণা ও মতাদর্শের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে তারা সমাজের পরিস্থিতি, অসঙ্গতি ও শাসকদের সিদ্ধান্তকে একতরফাভাবে মেনে না নিয়ে বরং তা বিশ্লেষণ ও প্রশ্ন করতে শুরু করে। তাই মবসন্ত্রাসীরা লাইব্রেরি ভাঙচুর করবে, বই পুড়িয়ে দেবে—এটা স্বাভাবিক।

মবসন্ত্রাসীরা জানে, একটা লাইব্রেরি মানে প্রচুর বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, জ্ঞানের ভাণ্ডার। যেখানে ভালো বই মানুষের জ্ঞানের জগৎকে বিস্তৃত হতে সাহায্য করে। পাঠককে ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে এবং তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার রসদ জুগিয়ে থাকে। এই উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি শাসকের প্রচার করা নির্দিষ্ট কোনো মতবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

মানুষ তাদের অধিকার, শোষণ ও অবিচার সম্পর্কে সচেতন হলে সবচেয়ে বড় ভয় অন্যায়কারী, অসৎ ও জুলুমকারীর। কারণ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষ বুঝতে পারে যে, তাদের দুর্দশার জন্য কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং অসাধু শাসক ও অন্যায়কারীরাও দায়ী।

স্বাধীনভাবে পড়ালেখার সুযোগ পেলে মানুষ নিজের মতো করে ভাবতে শেখে, যা কোনো নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির পক্ষে দমন করা কঠিন। একজন স্বাধীনচেতা পাঠক সহজেই মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয় না। স্বৈরাচারী শাসকরা প্রায়ই নিজেদের মহিমান্বিত করতে মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রচার করে। কিন্তু শিক্ষিত পাঠকসমাজ, যারা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, সহজেই এই প্রপাগান্ডা ধরতে পারে।

এসব কারণে, স্বৈরাচারী ও অন্যায়কারী শাসকরা প্রায়শই বই নিষিদ্ধ করে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে এবং মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারকে সীমিত করার চেষ্টা করে। কারণ তারা জানে যে একটি শিক্ষিত ও সচেতন সমাজকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

১৯১ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন