বিশ্বভক্ত ও পর্যটন-বান্ধব ছেঁউড়িয়া—আতঙ্কে লালন সাঁইয়ের আখড়া বাড়ি !

বৃহস্পতিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২:৫০ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া, যেখানে বাউল সম্রাট লালন ফকিরের আখড়া ও মাজার দেশের সবচেয়ে পরিচিত আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, আজ গভীর উদ্বেগের মুখোমুখি।
প্রতি বছর হাজারো ভক্ত, বাউল এবং পর্যটকদের পদচারণা আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংস্কৃতি-মেধাসমৃদ্ধ লালন স্মরণোৎসবকে ঘিরে এই জনপদে এক অনন্য উৎসব-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু ১৩৫তম তিরোধান দিবস (১৭-১৯ অক্টোবর ২০২৫) উপলক্ষে তিনদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে, লালন মাজার এবং তার অনুসারীদের উপর এক গভীর চক্রান্তের আলামত ছড়িয়ে পড়েছে।
চক্রান্তের ছায়া ও প্রশাসনের নির্লিপ্ততা
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একাধিক দরগা, ওলি-আউলিয়ার মাজারে ধারাবাহিক হামলা, ধর্মান্ধ উস্কানি এবং মৌলবাদী অপপ্রচারের বিস্তার, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। লালন-অনুসারী বাউল ও সাধু-সন্ন্যাসীদের জীবনযাপন, দর্শন, এবং মাজার এলাকায় গাঁজা সেবন নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ‘ধর্মবিরোধী’ অপবাদ তুলে সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে উগ্রপন্থীরা বিভেদ ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের চক্রান্ত সত্ত্বেও কুষ্টিয়ার প্রশাসন এখনো কার্যকর প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা তৎপরতার উপস্থিতিও চোখে পড়ছে না, ফলে স্থানীয়ভাবে উদ্বেগ-সংকট বেড়েছে।
হামলার পূর্ববর্তী দেশীয় উদাহরণ
গেল এক বছরে খানজাহান আলী, শাহজালাল, দেওয়ানবাগ, রাজবাড়ির নূরাল পাগলা মাজারসহ দেশের একাধিক দরগা-মাজারে হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৌলবাদী গোষ্ঠীর ‘ধর্ম রক্ষার’ নামে বর্ষীয়ান ফকির, সাধু-শিষ্য এবং দর্শনার্থীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, এই পরিকল্পনার পিছনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ধর্মবিদ্বেষী এবং বাউল জীবনাচরণকে ‘অশ্লীলতা’ বলে অপপ্রচারের বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
স্মরণোৎসবের পরিসর এবং বিদেশি ভক্তদের সমাগম
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত এই উৎসব শুধু বাংলাদেশের বাউল বা ফকির সমাজ নয়। ভারত, নেপাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালি, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশের পর্যটক, গবেষক এবং অনুসারীদের আকর্ষণ করে। ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়া বাড়ি এখন মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক সংযোগের আন্তর্জাতিক প্রাণকেন্দ্র। এমতাবস্থায়, এখানে হামলার চক্রান্ত এই সম্প্রীতির ঐতিহ্য ও পর্যটন বন্ধনের উপর বড় হুমকি হিসেবে সামনে এসেছে।
লালন দর্শন ও গবেষণার আন্তর্জাতিক অগ্রগতি
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লালন তথা বাউলতত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে ধরে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ইতালি, ফ্রান্সসহ বহু দেশে গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পিয়ার-রিভিউড জার্নাল, এমফিল/পিএইচডি থিসিস, সম্মেলন—এসব কাজের মূল উৎস ছেঁউড়িয়ার মাজার ও বার্ষিক স্মরণোৎসব। দেশ-বিদেশের গবেষক, শিক্ষার্থী ও গভীর আগ্রহসম্পন্ন পর্যটকরা লালনের গান, দেহতত্ত্ব, মানবতাবাদ ও সাধনার দর্শন জানতে সরাসরি এখানে আসেন।
চক্রান্তের কৌশল ও মৌলবাদী অপতৎপরতা
চক্রান্তকারীরা একদিকে মাজার ও সাধু-সন্ন্যাসীদের জীবনযাপনের প্রথা নিয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পুঁজি করে; অন্যদিকে গাঁজা সেবন, নির্যাতন, নারী-বিষয়ক অপপ্রচার ইত্যাদি দুর্বলতাকে অতিরঞ্জিতভাবে কুরুচিপূর্ণ বিষয় হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াচ্ছে। লক্ষ্য—সাধু, বাউল ও উৎসবের পরিবেশ ‘অপবিত্র’ বা ‘ধর্মবিরোধী’ বলে কুসংস্কারের আড়ালে উগ্র জঙ্গিবাদী হামলার জন্য জনমত তৈরি করা। প্রশাসনিক নজরদারি নেই বললেই চলে, স্থানীয় পর্যায়ে কয়েকটি মানববন্ধন ও প্রতিরোধী দল স্বতঃস্ফূর্ত হলেও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই; ফলে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। কুষ্টিয়া তথা দেশের মুক্তচিন্তার ধারায়, সংস্কৃতি, পর্যটন ও মানবতাবাদী ঐতিহ্যে বড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। লালনের দর্শন শুধু আঞ্চলিক নয়, জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির প্রতীক। তাই এটা রক্ষা করা একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক দায়, অন্যদিকে মাজারকে নিরাপদ রাখা হচ্ছে মৌলিক মানবিক কর্তব্য।
সচেতন সমাজ ও সম্ভাব্য প্রতিরোধ
স্থায়ী সমাধান আসতে পারে, যদি প্রশাসন, সাধারণ মানুষ, গণমাধ্যম ও সচেতন সমাজ একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্থানীয় জনগণ এবং ফকির-সাধু সমাজ বারবার প্রশাসনকে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে। সন্দেহজনক আচরণ, উস্কানিমূলক পোস্ট, মাজার এলাকায় অপরিচিত ব্যক্তিদের চলাফেরা ইত্যাদি সবার নজরে রাখা দরকার। পাশাপাশি মিডিয়ারও শক্তিশালী ভূমিকায় থাকতে হবে, যাতে যে কোনো অপপ্রচার-ধর্মীয় উগ্রতা-চক্রান্ত দ্রুত চিহ্নিত ও সামাজিকভাবে প্রতিহত করা যায়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়
আগামী ১৭-১৯ অক্টোবর—লালন সাঁই এর ১৩৫তম তিরোধান দিবসের বিশাল উৎসবকে স্বাধীন, সংহত ও নিরাপদ রাখার দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের নয়, কুষ্টিয়াবাসীসহ পুরো জাতির। কুমারখালী এবং ছেঁউড়িয়ার সাধুনিবাসী সাধু-বাউলদের চেতনা, ধর্মসমন্বয় ও দর্শনের বার্তা সমাজে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে পারস্পরিক বিশ্বাস, পর্যটনশিল্প ও আন্তর্জাতিক গবেষণা হুমকির মুখে পড়বে। তাই নিজেরা সতর্ক থাকুন, অপপ্রচার, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সত্যনিষ্ঠ প্রতিবাদ গড়ে তুলুন—এই আহ্বানই উঠে আসছে কুষ্টিয়ার সাধারণ মানুষ, গবেষক, সংস্কৃতিসেবী আর বৈশ্বিক পর্যটকদের কাছ থেকে।
শেষ কথা
এই সংকটে কুষ্টিয়াবাসীর ঐক্য, প্রতিরোধ, বাউল-সাধু ধর্ম ও লোকসংস্কৃতির শক্তি হয়ে উঠুক বহুমাত্রিক চক্রান্ত প্রতিহত করার প্রধান হাতিয়ার—লালনের দর্শন, কুষ্টিয়ার গৌরব আর মানবতার বানী অক্ষয় থাকুক।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩৩ বার পড়া হয়েছে