বিস্ফোরক গণবিক্ষোভে উত্তাল ভারত: কয়েক রাজ্যে মোদি বিরোধী ঝড়

রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ৬:০৬ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের গোড়ার দিক থেকে ভারতজুড়ে ক্রমবর্ধমান সামাজিক-রাজনৈতিক উত্তেজনা, ব্যাপক গণবিক্ষোভ এবং ভারত-পাকিস্তান সীমিত যুদ্ধ—এই তিনটি বড় ঘটনা দেশটির ইতিহাসে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে।
মণিপুর, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ-সহ একাধিক রাজ্যে ব্যাপক মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, বৈষম্য, অর্থনৈতিক সংকট ও ক্ষমতাকাঠামোগত দুর্বলতা নিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে, ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষের ক্ষত এখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
ছাত্র আন্দোলন থেকে সর্বজনীন গণআন্দোলন
নেপাল সরকারের পতনের প্রতিধ্বনি ভারতে পড়েছে প্রবল ভাবে। প্রথমে বিহারে চাকরিপ্রয়াসী ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যাপক আকার নেয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর বিহারের অনেক এলাকায় তারা রেল ও সড়ক অবরোধ করে। এরপর ১০ সেপ্টেম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামে মোড়ান সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়—তাদের দাবি, ‘তফসিলি উপজাতি’ (এসটি) মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন। অল মোড়ান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএমএসইউ)-এর উদ্যোগে তিনসুকিয়া শহরে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তাঁদের সতর্ক ঘোষণা—৭২ ঘণ্টার মধ্যে দাবি না মানলে ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ হবে।
বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রীয় ও কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা কংগ্রেস, বিজেপি ও আঞ্চলিক দলগুলোর ‘রাজনৈতিক ব্যবহার’-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান দেন।
অন্যান্য রাজ্যে গণবিক্ষোভ
পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র—এসব রাজ্যেও সরকারি নীতিতে বৈষম্য, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, শিক্ষক নিয়োগ জালিয়াতি ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বের অভিযোগে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থী, তরুণ, কর্মী ও কৃষক শ্রেণি। মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে, একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে মোদি সরকারের সফরের বিরোধিতা বৃহৎ আকার ধারণ করে।
বিক্ষোভকারীদের পাকিস্তান-অনুগত অপবাদ
সরকারপন্থী প্রচারমাধ্যম ও শাসকদলের ভেতর থেকে এসব আন্দোলনকারীদের ‘পাকিস্তানের দালাল’ ও ‘দেশদ্রোহী’ বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে এবং গ্রেফতার করা হচ্ছে। জনতাবিক্ষোভ, সমাবেশ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের প্রচার নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়েছে—ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভাজনকে আরও উস্কে দিয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার। অনেকেই বলছেন, ক্ষমতার টিকে থাকতে সরকার বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ও মিডিয়ার অপব্যবহার হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও আর্থিক ক্ষতি
এই বিপ্লবী পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ ভারত-পাকিস্তান সীমানায় সংক্ষিপ্তকালীন যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মাত্র ৮৭ ঘণ্টার এই সংঘাতে দুই দেশের সামরিক ও বেসামরিক স্তরে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেখানে ভারতে ক্ষতি পাকিস্তানের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। ভারতের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার অধিকাংশই শেয়ারবাজারপতন, অভ্যন্তরীণ লগিস্টিকস, সামরিক খাতে। পাকিস্তানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি, তুলনামূলক কম হলেও প্রবল অর্থনৈতিক সংকুচন। যুদ্ধের কারণে বিমান চলাচল, ক্রীড়া টুর্নামেন্ট ও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে দুই দেশের জনগণের উপর বিপুল আর্থিক চাপ পড়ে।
যুদ্ধ ও বিক্ষোভের অভিঘাত
কয়েকদিনের যুদ্ধেই ভারতের অর্থনীতিতে প্রবল ধাক্কা লাগে। শেয়ারবাজারে কিছুদিনের মধ্যে ৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যবিপর্যয় হয়। বিগত আড়াই দশকে এমন অর্থনৈতিক ক্ষতি কখনও হয়নি। সাধারণ মানুষ, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপর জীবনযাত্রার খরচ এবং বেকারত্ব আরও প্রকট হয় — ফলে সরকারের বিরুদ্ধে পোস্ট-যুদ্ধের বিক্ষোভ নতুন মাত্রা পায়।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ
বিরোধী দলগুলো এবং আন্দোলনকারীরা মনে করেন, মোদি সরকারের গদি মিডিয়া মূল সমস্যা আড়াল করছে, ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, সামাজিক অস্বস্তি, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, যুদ্ধকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। উপরন্তু, ‘পাকিস্তানের দালাল’ অপবাদ দিয়ে প্রতিবাদ দমন, নাগরিক অধিকার খর্ব — এসব কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন সামাজিক গবেষক এবং আন্দোলনকারীরা।
শেষ কথা
২০২৫ সালের ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপটে আন্দোলন, যুদ্ধ এবং প্রচারযুদ্ধ দেশটিকে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার মুখে দাঁড় করিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং গণতান্ত্রিক সংকট অনেকাংশেই ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক সংহতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৩২ বার পড়া হয়েছে