আধ্যাত্মিক আলোকবর্তিকা খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.)

মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৫ ৭:২১ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূল, ওলী-আওলিয়া, দায়ী ইলাল্লাহ ও আধ্যাত্মিক মনীষীদের।
তাঁদের আবির্ভাব কেবল ধর্মীয় অনুশাসন প্রচারের জন্য নয়, বরং মানবতার অন্তরজগতকে জাগ্রত করা এবং নৈতিক সমাজ বিনির্মাণ করা। অভিভক্ত ভারতবর্ষের দক্ষিণাঞ্চলে এমনই এক ক্ষণজন্মা আধ্যাত্মিক সাধকের আবির্ভাব ঘটে—তিনি হলেন আল্লামা শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন আল-কাদরী (রহ.) (১৮৫৪-১৯৫৫)।
শতবর্ষব্যাপী জীবনধারায় তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধনা, নৈতিক দৃঢ়তা, সেবামূলক কাজ এবং আল্লাহভীতি দ্বারা উজ্জ্বল এক জীবন্ত আলোকবর্তিকা। তাঁর জীবন ছিল ইসলামী শরীয়াহ ও সুফীয়াহর সমন্বিত প্রতিচ্ছবি।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়ঃ
খাজা ফয়েজ উদ্দীন আল-কাদরী (রহ.) ইংরেজি ১৮৫৪ সালে (হিজরি ১২৭০) বাকেরগঞ্জ জেলার মরিচবুনিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত ও আধ্যাত্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহসুফী খাজা ছলেমউদ্দীন (রহ.) ছিলেন আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক সাধক ও সমাজে প্রখ্যাত বুযুর্গ।
এই পরিবারের আধ্যাত্মিক উত্তরসূত্র গিয়ে মিশে যায় প্রখ্যাত সুফিয়ে কেবলা বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) পর্যন্ত। ফলে পারিবারিকভাবে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলেন।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দীক্ষা-
শিশুকাল থেকেই খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.) ইসলামী শিক্ষা অর্জনে মনোনিবেশ করেন। কোরআন ও হাদিস অধ্যয়ন, ফিকহ-তাসাউফের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি পীর-মুরিদী পরিমণ্ডলে আধ্যাত্মিক চর্চায় লালিত হন।
সুফিবাদে যেমন ‘শরীয়াহ, তরীকাহ, হাকীকাহ ও মারেফাহ’—এই চারস্তরীয় সাধনা পথ অনুসরণের কথা বলা হয়, তেমনি খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.) নিজের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটান।
শরীয়াহ: নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্জসহ ইসলামের মৌলিক বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ।
তরীকাহ: মুরশিদের সান্নিধ্যে থেকে অন্তরের পরিশুদ্ধি সাধন।
হাকীকাহ: জগতের আসল সত্য উপলব্ধি।
মারেফাহ: আল্লাহর সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন।
তিনি এ চারস্তরের সাধনা পথকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য- শাহসুফী খাজা ফয়জুদ্দীন (রহ.) ছিলেন শান্ত, নির্লোভ, স্বল্পভাষী, প্রচারবিমুখ অথচ দৃঢ়চেতা মানুষ। তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো:
১.আল্লাহভীতি ও তাকওয়া – তিনি সর্বদা আল্লাহর ভয়ে কাঁপতেন, নাম-যশ, ধন-সম্পদ বা জাগতিক লালসার প্রতি তাঁর কোনো আসক্তি ছিল না।
২.দুনিয়াবিমুখতা–দুনিয়াকে ক্ষণস্থায়ী ভেবে তিনি পরকালীন সাফল্যকেই মূল লক্ষ্য স্থির করেছিলেন।
৩.ইনসাফ, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা–পারিবারিক মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তিনি ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে কখনো আপস করেননি।
৪.নেতৃত্বগুণ – সমাজে তিনি ছিলেন একজন অভিভাবকসুলভ নেতা। তাঁর চিন্তা ও নির্দেশনা অনেকের জীবন পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।
৫.আধ্যাত্মিক সমাজ সংস্কারক-
সুফিবাদ কেবল ব্যক্তিগত সাধনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর লক্ষ্য হলো সমাজে নৈতিক বিপ্লব ঘটানো। খাজা ফয়জুদ্দীন (রহ.) এ নীতিই অনুসরণ করেছিলেন।
তিনি মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। মানুষকে কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য, অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করতে তিনি নিরলস কাজ করেন। সমাজের বঞ্চিত শ্রেণি, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে ইসলামের ছায়াতলে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন।
কোরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন— “يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ” (সূরা হুজুরাত: ১৩)
অর্থাৎ: “হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি নর ও নারী থেকে, এবং করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে সবচেয়ে পরহেযগার।”
এই আয়াতের মর্মকে তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন তাঁর সমাজ সংস্কারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অবদানঃ
খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.)-এর জীবদ্দশা ছিল এক অস্থির সময়ে। মোগল সাম্রাজ্যের পতন, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের আগমন এবং মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতা এই সময়ের বৈশিষ্ট্য,মুসলিমরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল,দীনী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব প্রয়োজন ছিল প্রবলভাবে। এমন সময় তিনি আবির্ভূত হয়ে ইসলামী শিক্ষা, আধ্যাত্মিক চর্চা ও নৈতিক পুনর্জাগরণের জন্য কাজ করেন।
সুফিবাদ ও ইসলামী দাওয়াত-সুফিবাদ আসলে দাওয়াতেরই আরেক নাম। দাওয়াত হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.) দাওয়াত প্রচারে ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি বড় বড় মঞ্চে নয়, বরং ব্যক্তিগত সংযোগ, খানকাহ, মসজিদ ও সামাজিক আড্ডায় মানুষের অন্তরে ইসলামের আলো জ্বালাতেন।
তিনি বাস্তবায়ন করতেন কোরআনের এ দাওয়াতি নীতি—“ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ” (সূরা নাহল: ১২৫)
অর্থাৎ: “আপনি আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন।
আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার-খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.) দীর্ঘ ১০১ বছর বেঁচে থেকে অসংখ্য ইসলামী ভাব ধারার অনুসারী ও শিষ্য তৈরি করে গেছেন। তাঁর শিষ্যরা সমাজে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর পরিবার, বিশেষত নবাব খাজা আহসানউল্লাহ ও ঢাকার খাজা পরিবার, সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হয়ে এ ঐতিহ্যকে আরো সম্প্রসারিত করেন।
তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার শুধু পরিবারেই সীমিত নয়, বরং সমগ্র বাংলার সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ঢাকার নবাব খান বাহাদুর নবাব খাজা আহসানুল্লাহর বংশধর।
ইসলামী ভাবধারায় খাজা ফয়েজ উদ্দীন (রহ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষাঃ
১.আল্লাহভীতি ও তাকওয়া–তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, দুনিয়ার মর্যাদার চাইতে আল্লাহর ভয় বড়।
২.মানবসেবা–ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ হলো মানুষের কল্যাণ। তিনি এটিকে বাস্তবায়ন করেছিলেন।
৩.শিক্ষা ও দীক্ষা – কোরআন-হাদিসভিত্তিক শিক্ষা ছাড়া আধ্যাত্মিকতা অপূর্ণ।
৪.ধর্মীয় সহনশীলতা–ইসলাম প্রচারে তিনি কঠোরতার পরিবর্তে ভালোবাসা ও প্রজ্ঞাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
শাহসুফী খাজা ফয়েজ উদ্দীন আল-কাদরী (রহ.) ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের একজন, যাঁর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে আধ্যাত্মিক সাধনা, দাওয়াতি কর্ম এবং মানবকল্যাণের সমন্বিত প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবন আমাদের জন্য এক অনন্য আদর্শ।
আজকের বিভক্ত, নৈতিক সংকটে জর্জরিত সমাজে তাঁর শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক জীবনধারা আমাদের পথ দেখায়— আল্লাহর ভয়কে জীবনের কেন্দ্র করা, সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ভালোবাসা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর শিক্ষা অনুসরণের তাওফিক দান করুন।
১৮৪ বার পড়া হয়েছে