সর্বশেষ

মতামত

ইরান-ইসরাইল ১২ দিনের যুদ্ধ: ব্যয়, ক্ষতি এবং পরনির্ভরশীলতা

মনজুর এহসান চৌধুরী
মনজুর এহসান চৌধুরী

বৃহস্পতিবার , ৩ জুলাই, ২০২৫ ৫:০৮ পূর্বাহ্ন

শেয়ার করুন:
২০২৫ সালের জুনে মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘটিত ১২ দিনের যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

এই স্বল্পমেয়াদি কিন্তু তীব্র সংঘাত দুই দেশের জন্যই ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, ধ্বংসাত্মক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যুদ্ধের আর্থিক ব্যয়, ক্ষয়ক্ষতি ও দুই পক্ষের পরনির্ভরশীলতা নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।


যুদ্ধের সূচনা ও সামরিক অভিযান
১৩ জুন ভোরে ইসরাইল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবনে ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার, সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ, পারমাণবিক বিজ্ঞানীসহ বহু সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের দিকে নিক্ষেপ করে, যার ফলে উভয় দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ইসরাইলের ব্যয় ও ক্ষতি
মোট আর্থিক ক্ষতি: ইরানের হামলায় ইসরাইলের সরাসরি মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
প্রায় ৩৩ হাজার বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে। এসব ভবন পুনর্নির্মাণে আনুমানিক ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে।
ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনে অবকাঠামো ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রয়োজন হয়েছে।
ইরানের হামলায় ইসরাইলি স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক পতন ঘটে এবং দেশের মোট রপ্তানির ৮% বাজার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইরানের হামলায় ইসরাইলের ২৯ জন নিহত এবং ১৫ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই ইসরাইলের সামরিক ব্যয় ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ৭২৫ মিলিয়ন ডলার।

ইরানের ব্যয় ও ক্ষতি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের সরাসরি ও পরোক্ষ ক্ষতি ২৪ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে, যা দেশের জিডিপির ৬.৩-৯.২ শতাংশ।
ইসরাইলি হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি ও বেসামরিক অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুদ্ধের সময় ইরানের তেল রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, ফলে রাজস্ব ক্ষতি হয় এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়।
ইরানে নিহত হয়েছেন অন্তত ৬২৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৪,৮৭০ জন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।

সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র ব্যবহারে পরনির্ভরশীলতা

ইসরাইলের পরনির্ভরতা:
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি F-35, F-15, F-16 যুদ্ধবিমান, GBU-57 বাঙ্কার-বাস্টার বোমা, THAAD ও Patriot ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেছে।
Microsoft, Palantir, Google, OpenAI-এর মতো মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করেছে।
বিভিন্ন ইউরোপীয় ও দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানির ভারী যন্ত্রপাতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক সহায়তা পেয়েছে।
মোসাদ বিদেশি প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে নাশকতা ও সাইবার হামলা পরিচালনা করেছে।

ইরানের পরনির্ভরতা:
প্রধানত নিজস্ব তৈরি ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
কিছু ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া থেকে প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করেছে বলে ধারণা করা হয়, তবে ১২ দিনের যুদ্ধে এসব অস্ত্র সরাসরি ব্যবহারের তথ্য নেই।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি:
যুদ্ধের ফলে উভয় দেশেই অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বাজেট ঘাটতি, বিনিয়োগ হ্রাস ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। ইসরাইলের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬% ছাড়িয়ে গেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ ৬০%-এর বেশি কমে গেছে। ইরানও তেল রপ্তানি ও অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে চাপে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মহল দুই পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা ও নিরাপত্তা সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

আসল কথা
ইরান-ইসরাইল ১২ দিনের যুদ্ধ দুই দেশের জন্যই ছিল চরম ব্যয়বহুল ও ধ্বংসাত্মক। ইসরাইল তুলনামূলকভাবে বেশি পরনির্ভরশীল ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক-প্রযুক্তি সহায়তার ওপর, আর ইরান প্রধানত নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করেছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দুই দেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, এবং মধ্যপ্রাচ্যে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

১৮৬ বার পড়া হয়েছে

শেয়ার করুন:

মন্তব্য

(0)

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন
মতামত নিয়ে আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

২৫০ x ২৫০

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
৩২০ x ৫০
বিজ্ঞাপন