অধিকাংশ আসক্ত গাঁজা ও ইয়াবায়; বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তরুণ সমাজ

বৃহস্পতিবার , ২৬ জুন, ২০২৫ ৮:০৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার করুন:
দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ৮৩ লাখে পৌঁছেছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪.৮৯ শতাংশ। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) এই সমীক্ষাটি প্রথমবারের মতো পরিচালনা করেছে, যেখানে দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলার ৫ হাজারের বেশি মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের করা এক সমীক্ষায় দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ধরা হয়েছিল ৩৬ লাখ। নতুন প্রতিবেদনটি দেশের মাদক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতিকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
পুরুষদের সংখ্যাই বেশি, ঝুঁকিতে নারী-শিশুরাও
ডিএনসির তথ্য অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের মধ্যে পুরুষ ৭৭ লাখ ৬০ হাজার, নারী ২ লাখ ৮৫ হাজার এবং শিশু-কিশোর ২ লাখ ৫৫ হাজার জন।
গাঁজা-ইয়াবার আগ্রাসন
মাদকসেবীদের মধ্যে প্রায় ৬১ লাখ গাঁজা, ২৩ লাখ ইয়াবা, ২০ লাখ মদ্যপানে, ৩ লাখ ৪৬ হাজার ফেনসিডিল ও সমজাতীয়, ৩ লাখ ২০ হাজার হেরোইনে এবং ৩ লাখ ঘুমের ওষুধে আসক্ত। ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষ আঠা (ড্যান্ডি) সেবন করেন এবং প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ শিরায় মাদক গ্রহণ করেন।
তবে সমীক্ষায় স্পষ্ট করা হয়েছে, অনেকেই একাধিক মাদকে আসক্ত। তাই মোট সংখ্যা ১ কোটি ১৭ লাখ ছাড়ালেও প্রকৃত আসক্ত ব্যক্তি ৮৩ লাখে সীমিত।
সীমান্ত ঝুঁকি: ১০৪টি পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ
দেশে মাদক উৎপাদিত না হলেও অরক্ষিত সীমান্ত পথ ও ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে মাদকের প্রধান ট্রানজিট রুটে পরিণত করেছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং গোল্ডেন ওয়েজ রুটে বাংলাদেশের অবস্থান মাদকের প্রবেশ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ডিএনসির ‘ড্রাগ রিপোর্ট–২০২৪’ অনুযায়ী, দেশের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট রয়েছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে (৪৩টি), এরপর পূর্বাঞ্চল (২১টি), উত্তরাঞ্চল (২১টি) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে (১৯টি, কক্সবাজার কেন্দ্রিক)।
গডফাদারদের ধরা জরুরি: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
মাদক নিয়ন্ত্রণে সীমিত অগ্রগতির কথা স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আপনারা যা চেয়েছেন, তা-ই দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। এখন আর মাদক বহনকারীকে ধরে লাভ নেই, ধরতে হবে গডফাদারদের।”
তিনি আরও বলেন, “দুটি জিনিস এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি—মাদক ও দুর্নীতি।”
চিকিৎসায় বিপর্যয়, সরকারি শয্যা মাত্র ২৭৯
দেশে সরকারি পর্যায়ে মাত্র ২৭৯টি শয্যা রয়েছে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য। ঢাকায় কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সর্বমোট ১৯৯টি শয্যা, জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ৫০টি এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৩০টি শয্যা চালু আছে।
বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে ৩৮৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র। সরকার আরও ৮টি বিভাগে ২০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ঢাকায় ২৫০ শয্যার একটি আধুনিক কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে।
তরুণরা বড় ঝুঁকিতে
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, “মাদকাসক্তদের বড় অংশ তরুণ-যুবক। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা জরুরি। না হলে তারা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।”
বিচার ব্যবস্থায় দুর্বলতা
ডিএনসির হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৬৯৮টি মামলার রায় হয়েছে, এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত ও সাক্ষ্য দুর্বল হওয়ায় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা বারবার আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
মাদক ধ্বংস করে পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি
জাতিসংঘের আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদক পাচারের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পাচার হয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ বিপদ।
একজন সাবেক সচিব জানান, মাদকের কারণে তাঁর ছেলের ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, “একজন মাদকাসক্তই একটি পরিবারকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।”
১২১ বার পড়া হয়েছে