ইসরাইলের আগ্রাসন, পশ্চিমা সমর্থন ও মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সংকট

বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫ ২:৩৮ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সামরিক নীতি ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসে একতরফা হামলা, গাজা ও লেবাননে সামরিক অভিযান এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের ঘটনাগুলো এই বিতর্ককে আরও গভীর করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—ইসরাইল কি কেবল নিজের নিরাপত্তার অজুহাতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করছে? পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন ছাড়া কি ইসরাইল এই ধরনের “মাস্তানি” চালাতে পারত? এবং, আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচার কি এখানে কার্যকর?
ইসরাইলের আগাম হামলার নীতি ও “বেগিন ডকট্রিন”
ইসরাইলের নিরাপত্তা নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—“বেগিন ডকট্রিন”। ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক রিয়াক্টরে ইসরাইলি বিমান হামলার মাধ্যমে এই নীতির সূচনা। ইসরাইলি নেতৃত্বের যুক্তি ছিল, শত্রুপ্রতিম কোনো রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে তা ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তাই, আন্তর্জাতিক সমর্থন থাক বা না-থাক, ইসরাইল আগাম সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। এই নীতির বাস্তবায়ন দেখা গেছে ইরান, সিরিয়া, গাজা এবং লেবাননে।
বেগিন ডকট্রিন নীতিতে হামলাগুলো
ইসরাইলি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং “হুমকি”র নিজস্ব ব্যাখ্যায় একতরফা হামলা চালানো হয়েছে। বেগিন ডকট্রিনের আওতায় ইসরাইল একতরফাভাবে (প্রিভেন্টিভ অ্যাকশন) ইরাক (অপারেশন অপেরা, ১৯৮১), সিরিয়া (অপারেশন অর্চার্ড/সাইলেন্ট টোন, ২০০৭) এবং ইরান (অপারেশন রাইজিং লায়ন, ২০২৫)-এর পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে—সবগুলোতেই যুক্তি ছিল ইসরাইলের অস্তিত্বগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বেগিন ডকট্রিন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়, এটি ইসরাইলের একতরফা নিরাপত্তা নীতি, যা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের দৃষ্টিতে বৈধতা পায় না এবং একাধিকবার নিন্দিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগাম হামলা চালানো আইনগতভাবে বৈধ নয়, যদি না তাৎক্ষণিক ও অপ্রতিরোধ্য হুমকি থাকে। ১৯৮১ সালের ওসিরাক হামলা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে, ইসরাইলের মতো সামরিক শক্তিধর ও পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইসরাইলের যুক্তি—নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য “প্রয়োজনীয়” পদক্ষেপ—আন্তর্জাতিক আইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও আইনবিধি দুর্বল হয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকাঃ “পোষা গুন্ডা”র বাস্তবতা
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের প্রধান মিত্র। ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও সামরিক অংশীদার, এবং গাজা যুদ্ধের পরও অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও, “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” ঘোষণার মতো কঠোর পদক্ষেপ ইউরোপের মূলধারায় নেই। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স—এরা ইসরাইলের নিরাপত্তাকে “বিশেষ দায়িত্ব” বলে বিবেচনা করে। স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম কিছুটা কঠোর অবস্থান নিলেও, ঐকমত্যের অভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে, ইসরাইল কার্যত পশ্চিমাদের “পোষা গুন্ডা” হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অভিযান চালাতে পারছে—এটি বাস্তবতা।
মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সংকট ও আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া
ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির ফলে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরবসহ পুরো অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত, লেবাননে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা, সিরিয়ায় বিমান হামলা—এসবই আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে। সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক—এরা ইসরাইলকে “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” আখ্যা দিলেও, আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর হয়নি। ইরান ও তার মিত্রদের প্রতিক্রিয়া আরও সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
“সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” ঘোষণার বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
ইসরাইলের বিরুদ্ধে “সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” ঘোষণার দাবি উঠলেও, আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা কার্যকর নয়। জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা, পশ্চিমা সমর্থন ও আঞ্চলিক বিভাজন—এসব কারণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। ইউরোপের অভ্যন্তরেও ইসরাইল ইস্যুতে বিভাজন স্পষ্ট; মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা থাকলেও, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কড়া পদক্ষেপ অনুপস্থিত।
শেষ কথা
ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি ও পশ্চিমা সমর্থন মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সংকটকে আরও গভীর করেছে। “নিজস্ব নিরাপত্তা”র অজুহাতে ইসরাইল একতরফা হামলা চালিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করছে, আর পশ্চিমা বিশ্ব নীরব সমর্থন বা সরাসরি সহযোগিতা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচার এখানে কার্যত অকার্যকর। এই পরিস্থিতি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যও হুমকি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রশ্নে দ্বৈতনীতি পরিহার করে, প্রকৃত অর্থে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা—যাতে কোনো রাষ্ট্র “নিজস্ব নিরাপত্তা”র অজুহাতে অন্যদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলতে না পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
১১৬ বার পড়া হয়েছে